সুচরিতা সেন চৌধুরী: সেবারের বেড়ানোটা খুব একটা ভাল হয়নি। মাঝে মাঝে এমনটা হয়। খারাপ গাড়ি চালক, খারাপ হোটেল, খারাপ ট্র্যাভেল এজেন্ট—যখন খারাপ হয় সব এক সঙ্গেই হয়। সেবারও তাই হয়েছিল। হিমাচলের ডালহৌসি, খাজিয়ার, চাম্বা, ধর্মশালা ছিল বেড়ানোর তালিকায়। সেই প্রথম এবং সেই শেষবারের মতো ট্র্যাভেল এজেন্ট দিয়ে সব কিছু বুকিং করেছিলাম। ট্যুরিজম ফেয়ার থেকে এক হিমাচলের এজেন্টের মাধ্যমে। তাঁদের ভাল ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েই ভুলটা হয়ে গিয়েছিল। প্রথম থেকেই ধাক্কা খেয়েছিল ট্যুর। পাঠানকোট থেকে শুরু হয়েছিল বেড়ানো। সেই স্টেশনের কথা পড়ে বলব। আজ বলব কাংড়া স্টেশনের কথা। যেখান থেকে ফিরেছিলাম। সেদিন মনে মনে বলেছিলাম যার শেষ ভাল তার সব ভাল।
পুরো ট্যুরটা এতটাই খারাপ ছিল যে দ্রুত সেখান থেকে ফিরতে চাইছিলাম। বিশেষ করে গাড়িটা ছাড়তে চাইছিলাম। কারণ চূড়ান্ত খারাপ ছিল সেই গাড়ি চালক। পাঠানকোট টু পাঠানকোট বুকিং থাকলেও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাকিটা আমরা ট্রেনে ফিরব। খোঁজ নিয়ে জানা গেল কাংড়া ভ্যালি রেলওয়েজের কথা। তবে ন্যারোগেজ লাইন। পাহাড়ের ধাপ ভেঙে ভেঙে এগিয়ে যাওয়া, মন্থর গতি। তাও সই, খারাপ মানুষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। জানা গেল কাংড়া থেকে পাঠানকোট পৌঁছতে লেগে যাবে ৫-৬ ঘণ্টা। রিজার্ভেশনেরও কোনও বালাই নেই। এক কথায় লোকাল ট্রেন।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম কাংড়া মন্দির রেল স্টেশনে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই। তবে গাড়ি ছেড়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ও এখানে বলে রাখি এই কাংড়া ভ্যালি রেলওয়েজ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের আখ্যা পেয়েছে। স্টেশন চত্তরটা খুবই ম্যাড়ম্যাড়ে। রংচটা দেওয়াল। ছোট্ট টিকিটঘর। ইতিউতি স্থানীয় মানুষদের আনোগোনা। সঙ্গে জিনিসপত্র। না, কোনও ট্যুরিস্ট দেখিনি পুরো জার্নিটায়। কিন্তু কোথা দিয়ে যে স্থানীয়দের সঙ্গে জমে গিয়ে রাস্তা ছোট হয়ে যাবে টেরই পাওয়া যাবে না।
টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্ম চত্তরে পা দিয়েই মনটা ভাল হয়ে গেল। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেল লাইন। জানা গেল পুরো রাস্তাটাই খুব ছোট মানে চওড়া দু’ফিট ছ’ইঞ্চি। আর তার পরই বিশাল খাদ। ১৯২৯ সালে তৈরি হয়েছিল এই লাইন। ২২১১ ফিট উচ্চতার এই স্টেশন চত্তর থেকে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় তুষার শৃঙ্গ। কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে স্টেশন চত্তর। সূর্যের আলো ঢোকে না এখানে। ঝড়া পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্মে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্যের সঙ্গে সময় কেটে যায় নিশ্চিন্তে। ট্রেনের অপেক্ষাও তখন বিরক্তিকর হয় না।
বেশ অনেকক্ষণ পড়েই ট্রেন ঢুকল সর্পিল গতিতে। প্রথম দিকের স্টেশন হওয়ায় বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম জানলার ধারে। কিছুক্ষণের অপেক্ষার পর ট্রেন ছাড়ল। এই পথে প্রতিটি স্টেশনই ছবির মতো সুন্দর। কাংড়া মন্দির থেকে পাঠানকোটের যে দীর্ঘ রাস্তা তার প্রতিটি স্টেশন মনের কোণায় জায়গা করে নিয়েছিল। কাংড়া মন্দিরের পরের স্টেশন কাংড়া। এক স্থানীয় দোকানদার বলে দিয়েছিলেন, কাংড়া মন্দির থেকে ট্রেন ধরার কথা কারণ কাংড়া থেকে ট্রেনে ভিড় হবে। ঠিকই বলেছিলেন। কাংড়া থেকে পুরো ট্রেনটাই ভর্তি হয়ে গেল। অনেক বছর আগের কথা হওয়ায় পুরোটা মনে না থাকলেও অনুভূতি হারিয়ে যায়নি।
এর পর যে স্টেশনে থামল ট্রেন তার নাম জ্বালামুখী। হিমাচলের বিখ্যাত ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন এই জ্বালামুখী। এখানে বেশ অনেকটা সময়ই দাঁড়াল ট্রেন। কাংড়া মন্দির স্টেশন চত্তর থেকে যে তুষারশৃঙ্গ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল তা এই স্টেশন থেকে একদম স্পষ্ট। ধৌলাধার পাহাড়ের সৌন্দর্য্যের কথা তো সবারই জানা। হিমালচলকে ঘিরে রেখেছে এই বিশাল পাহাড়। পুরো রাস্তাটাই সঙ্গে সঙ্গে চলল প্রায়। জ্বালামুখী স্টেশনে নেমেও অনেকটা সময় কাটানো যায়। এখানেই একে অপরকে ক্রস করল দুটো ট্রেন। এতটাই পাশাপাশি যে এক ট্রেন থেকে লাফিয়ে সহজেই অন্য ট্রেনে চলে যাওয়া যায়।
এখানে স্টেশনের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাটাও একটা অসম্ভব সুন্দর জার্নির অংশ। সব স্টেশনের নাম এখন আর মনে নেই। তবে মনে আছে বিশালাকার জলরাশির সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া। জ্বালামুখী স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পরই বাঁদিকে চোখে পড়ল বিশাল জলরাশি। অপূর্ব সুন্দর সেই দৃশ্য। যা লিখে বোঝানো মুশকিল। স্থানীয়দের থেকে জানতে পারলাম বিপাশা নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে এই রিজার্ভার। যার একাধিক নাম রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম মহারানা প্রতাপ সাগর। সাগরই বটে, যার একূল ওকূল দেখা যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সঙ্গে চলে বিপুল সেই জলরাশি। জানা গেল এখান থেকেই পুরো হিমাচলে জল সরবরাহ হয়। কাংড়া থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জলাশয়। এই জলাশয়কে ঘিরে রয়েছে ধৌলাধার পাহাড়। যার ছায়া পড়ে জলের শরীরে। ৪১.৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে এই রিজার্ভার। যার গভীরতা ৩২১ ফিট।
বাকি পথটা প্রায় পুরোটাই সঙ্গে সঙ্গে চলবে এই বিপুল জলরাশি। মাঝে মাঝে দেখা মিলবে ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি স্টেশনের। বারিয়াল হিমাচল, নাগোরটা, ভারমার, ডালহৌসি রোড-সহ একাধিক স্টেশনের। যেখানেই ট্রেন দাঁড়াবে নেমে স্টেশনটিকে উপভোগ করাই যায়। স্থানীয় খাবার কিনে খাওয়া যায় ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে। পুরো রাস্তাটাই জুড়ে রয়েছে অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতি। পেরিয়ে যেতে হবে একটার পর একটা ব্রিজ। পাহাড়ের বুকচিরে অত উঁচুতে ব্রিজ অবাক করবে। মন্থর গতিতে ট্রেন এগিয়ে চলবে। একটা সময় এসে যাবে ডেস্টিনেশন। তার আগেই চলন্ত ট্রেন থেকে দিনের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতেই হবে। আকাশে রঙের হোলি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাওয়া পাঠানকোটে। যেখানে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো বিদায় জানানো যাবে ধৌলাধার শৃঙ্গকে। অন্ধকার নামবে পঞ্জাবের অন্তিম স্টেশনে বাড়ি ফেরার বার্তা নিয়ে।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে