কসৌলি: প্রকৃতি আর ইতিহাস জড়িয়ে থাকে এই হিমাচলী শহরে

কসৌলিহোটেলের ঘর থেকে কসৌলি শহর।

কসৌলি হিমাচলের শুরু বলা যেতে পারে। কালকা স্টেশনে নামলেই হিমাচলের পাহাড় দুই বাহু মেলে আপ্যায়নের জন্য তৈরি থাকে। সেই কবে থেকেই দেখছি, প্রথম যে বার সিমলা গিয়েছিলাম। এরকম পাহাড়ের শুরুর স্টেশনগুলো সব সময়ই আমাকে বড্ড টানে। ফেরার দিন অনেকটা আগে স্টেশনে পৌঁছে যাই এই লোভে যে সেই স্টেশনটাকে আরও ভালো করে দেখব। তবে আজ স্টেশন নয় আজ বলব কসৌলি হিল স্টেশনের কথা। লিখলেন মেঘ চক্রবর্তী


তখনও লকডাউন হয়নি দেশ জুড়ে। কলকাতা থেকে দিল্লি ফিরেছি ১৫ ফেব্রুয়ারি। মনটা একটু পাহাড় চাইছিল। মন চাইলে তা কি আর দমিয়ে রাখা যায়? তাই দোলের দিন দেখে সকাল সকাল নয়া দিল্লি স্টেশন থেকে শতাব্দিতে চেপে বসলাম। হ্যাঁ, তখন থেকেই ভাইরাসের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই মাস্ক সঙ্গী করেই পাহাড়মুখো হলাম কাক ভোরে। প্রিয় কালকা স্টেশনে যখন নামলাম তখন সূর্যিমামা মধ্য গগনে পৌঁছে গিয়েছে। ছ’ঘণ্টার ট্রেন যাত্রা।

কালকা স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম কসৌলির উদ্দেশে। হোটেল বুক করাই ছিল। ড্রাইভার নাম শুনে বললেন ওটা ঠিক কসৌলি শহরের মধ্যে নয় একটু বাইরে। শুনে মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। কালকা থেকে এক ঘণ্টার রাস্তা কসৌলি। আমাদের হোটেল খুঁজে পেতে একটু দেরি হল। কারণ সত্যিই হোটেলটির অবস্থান রীতিমতো নির্জন পাইন বনের মধ্যে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে চড়াই ভেঙে তবেই পৌঁছতে হয়। কারণ গাড়ির রাস্তা এখনও তৈরি হয়নি। কাজ চলছে।

হোটেলের পিছনের ব্যালকনি থেকেই শুরু পাইন বন, যেখানে চা নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেকটা সময়

তাতে কী পুরো পাইন বনে ঘেরা একটা ঘর আর তার সামনে গাছ ভর্তি গোলাপি চেরি ফুল মুহূর্তেই মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে। ও, বলে রাখা ভালো মার্চের মাঝামাঝি সময়ে দিল্লির আবহাওয়া বেশ ভালোই থাকে। তবে ঠান্ডা নেই। কিন্তু কালকায় নেমেই টের পেয়েছিলাম ঠান্ডাটা বেশ জম্পেশ রয়েছে ওখানে। কসৌলি পৌঁছে সেটা নিশ্চিতও হওয়া গেল। এদিন শুধুই বিশ্রাম। আর হোটেলের ব্যালকনিতে বসে প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে, জমিয়ে চায়ের আসর আর পরদিনের বেড়ানোর পরিকল্পনা করে ফেলা।

এই হোটেলের নিচ দিয়েই চলে গিয়েছে কালকা-সিলমা বিখ্যাত সেই টয় ট্রেনের লাইন। সকাল সকাল সেই ট্রেনের হর্ণে ঘুম ভাঙতেই পারে। ছোট্ট ক্যান্টনমেন্ট শহর এই কসৌলি অবস্থিত সোলান জেলায়। ব্রিটিশরা ১৮৪২-এ তৈরি করেছিল এই শহর। সিমলা থেকে ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কসৌলি। পাহাড়ের আনাচ-কানাচ আজও সেই ব্রিটিশ রাজের ছোঁয়া লেগে রয়েছে। খুব বেশি বদলায়নি মোটেও। ব্রিটিশদের তৈরি করা কসৌলি সার্কিট হাউস তার অন্যতম নিদর্শন।

যদি ভেবে থাকেন অনেক সাইট সিন বা শপিংয়ের সুযোগ আছে তাহলে বলব প্লিজ যাবেন না। কসৌলিতে শুধু হেঁটে বেড়ান রাস্তায়, বসে থাকুন প্রাচীন চার্চে রঙচটা বেঞ্চে, ঘুরে বেড়ান  হেরিটেজ মার্কেটে। এখানে ট্যুরিস্টের বাড়বাড়ন্ত নেই, জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজারের আশপাশে।

ব্রিটিশ আমলের ক্রাইস্টচার্চ, অদ্ভুত এক শান্ত পরিবেশ এই চত্তরে

ব্যাপ্টিস্ট চার্চ (১৯২৩), ক্রাইস্ট চার্চের (১৮৫৩) প্রতিটি কোণায় আজও -ব্রিটিশ আমলের আধিপত্ত। ২০০৮-এ পুড়ে গিয়েছিল এই ব্যাপ্টিস্ট চার্চের ভিতরের সব কিছু।  গুরুদ্বার, কৃষ্ণভবন মন্দির, কসৌলি ক্লাব, নাহরি মন্দির, হনুমান মন্দির, এটি মাঙ্কি পয়েন্ট বলেও খ্যাত। এয়ারফোর্স স্টেশনের একদম কাছে। হেঁটে পৌঁছতে হয় সেখানে। রামায়নের কাহিনী অনুযায়ী হনুমান যখন সঞ্জিবনী বুটি নিয়ে ফিরছিল তখন তার একটি পা এই পাহাড়কে ছুঁয়ে গিয়েছিল। যে কারণে এই পাহাড়ের মাথার অংশ পায়ের মতো দেখতে। রাতে মাঙ্কি পয়েন্ট থেকে নিচে চণ্ডিগড় শহরের আলোর খেলা দেখা যায়। যেমন মুসৌরি থেকে দেখা যায় দেরাদুন।

সব দেখা হলে যখন পেটে ছুঁচোর ডন দেবে তখন হেরিটেজ মার্কেটের কোনও বিকল্প নেই। আমার মতো শপিং পাগল মানুষও এই মার্কেট থেকে তেমন কিছু কেনার খুঁজে পায়নি। স্থানীয় কিছু কাঠের জিনিস, মেয়েদের সাজার জিনিস, গরম জামা-কাপড় ব্যস। তবে এই মার্কেটের ভিতর পেটপূজো করতে ঢোকাটা কাজে দিয়েছে। এতো সুস্বাদু ড্রাই চিলি মাশরুম আমি এর আগে কখনও খাইনি। সঙ্গে চাউমিন আর গরম গরম কফি।

ব্রিটিশদের তৈরি হেরিটেজ মার্কেট

মার্কেটে ঢোকার মুখেই রয়েছে হকির জাদুগর ধ্যানচাঁদের একটি মূর্তি। ওখানে ধ্যানচাঁদ কেন সেটা নিয়ে ভাবা হয়নি।

আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে দেখে মার্কেট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টি আসবে নিশ্চিত। কনকনে হাওয়া তো রয়েছেই। জাকিয়ে বসেছে শীত। গাড়ির ভিতর ঢুকে স্বস্তি মিলল। ছিটেফোটা বৃষ্টি ততক্ষণে কিছুটা ভিজিয়ে দিয়েছে। রাস্তায় মিষ্টির দোকান দেখে বাঙালি মন না দাঁড়িয়ে পারল না। পুরো রাস্তাতেই বৃষ্টি পেলাম। হোটেলে ঢুকতে আরও খানিকটা ভিজলাম। পাহাড়ের বৃষ্টিতে ভিজলে মনটা শীতল হয়ে যায়।

ভেজা জামা-কাপড় বদলে লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেলাম সোজা। বাইরে তখনও ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। তেজ বেড়েছে বোঝা যাচ্ছে। রাতের খাওয়ায় তাই গরম গরম খিচুরি আর অমলেট, জমে গেল পুরো। ঘুম আসতে দেড়ি হল না। সারাদিন ঘোরাঘুরির ক্লান্তি তো ছিলই। পরদিন ফেরা। বিকেলে কালকা থেকে আবার সেই শতাব্দিই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে দিল্লিতে যে দু’দিন আগে ছেড়ে গিয়েছিল।

হেরিটেজ মার্কেটের চাউমিন আর ড্রাই চিলি মাশুরুমের স্বাদ কখনও ভুলব না

পর দিন সকাল হল, মেঘলা আকাশ নিয়েই। মেঘ আমার সব সময়ই পছন্দের। হোটেলের পিছনের পাইনের জঙ্গলটা দেখার সুযোগ হয়নি। শেষ বেলায় তাই সকালটা ওখানেই কেটে গেল পাইন গাছে হেলান দিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে। লাঞ্চ করে সুন্দরী কসৌলিকে বিদায় জানালাম। ওই যে বলেছিলাম একটু দ্রুতই পৌঁছে যেতে চাই কালকা স্টেশনে। যদিও খুব চেনা এই কালকা, তবুও। ঝেপে বৃষ্টি এল। দূরের পাহাড়ের সবুজটাকে যেন এই স্টেশন থেকে আরও গাঢ় লাগছে আজ। ট্রেন ছাড়ার আগে পর্যন্ত স্টেশন চত্তরে দাঁড়িয়েই রোদ-বৃষ্টির খেলা দেখলাম। একটা সময় বিদায় জানাতেই হল, তবে আবার ফিরব কালকা স্টেশনে অন্য কোনও গন্তব্যের উদ্দেশে।

ছবি: লেখক

(বেড়ানোর আরও খবর পড়তে ক্লিক করুন)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)