সুচরিতা সেন চৌধুরী: ‘‘বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস/এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে’’
দার্জিলিং তো ছোট বেলার ক্রাশ যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বেড়েছে। সে দার্জিলিংয়ের ম্যাল হোক বা অলিগলি ধরে অচেনা পথে হারিয়ে যাওয়া। ক্রমশ ঘিঞ্জি তকমা পাওয়া দার্জিলিংয়ের প্রতি আমার কখনও খারাপলাগা তৈরি হয়নি। কখনও ফাঁকা ধুধু দার্জিলিং দেখেছি কখনও থিক থিকে ভিড়। ভাললাগাটা একই থেকে গিয়েছে। এ এক অমোঘ টান। যা প্রতিবছর সব প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে পৌঁছে দেয় এই শৈল শহরে। তবে ভালবাসার স্টেশনের কথা লিখতে বসে বার বার মনের কোণায় উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ওই পথের অন্য এক স্টেশন। যার নাম ঘুম। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে আমার ভালবাসার তালিকায় অনেকটাই এগিয়ে থাকবে ঘুম স্টেশন।
ভারতের সর্বোচ্চ রেল স্টেশনের তকমা রয়েছে ঘুমের গায়ে। ৭,৪০৭ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত স্টেশনকে সব সময় আঁকড়ে থাকে মেঘের দল। সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। শীতে বরফের চাদরে ঢেকে যায় স্টেশন চত্তর। এই স্টেশনের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সেই ছোট্টবেলায়। উত্তরবঙ্গে থাকার সুবাদে মাঝে মাঝেই দার্জিলিং যাওয়াটা ছিল রুটিনের মতো। তবে সব বারই শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি করেই পাহাড়ের পথ ধরেছি। একবারই শুধু ট্রেনে করে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ে পৌঁছেছিলাম।
ছোট্ট কয়লার ইঞ্জিন কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল। মন্থর তার গতি। কিন্তু জানলার বাইরে ক্রমশ বদলে যাওয়া প্রকৃতিটা তখনও দারুণ লেগেছিল। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ছিল ট্রেনটা। কিন্তু যখন ঘুমে এসে দাঁড়াল তখন সেই স্টেশন চত্তর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনি। মনে আছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ট্রেন। আমরা প্ল্যাটফর্মে নেমে ঘুরছিলাম। দিনের আলোতেও স্টেশন চত্তরটা কেমন যেন অন্ধকার। ব্রিটিশ আমলের পরিকাঠামো, করিবরগার গায়ে হিন্দি আর ইংরেজিতে লেখা ঘুম। ছোট ছোট বেঞ্চে আড্ডা জমিয়েছেন স্থানীয়রা। লাইনের সমান সমানই প্ল্যাটফর্ম। যার পুরোটা জুড়ে রয়েছে মেঘের আস্তরণ। কনকনে হাওয়া কাঁপুনি ধরাচ্ছে। গরম জামা-কাপড় চাপিয়ে নিতে হল।
সেই প্রথম দেখা ঘুম স্টেশনের সঙ্গে। এর পর থেকে কতবার যে দার্জিলিং গিয়েছি তার আর হিসেব নেই। প্রতিবছর অন্তত একবার এই জায়গাগুলো ছুঁয়ে আসতে না পারলে সময়টা কেমন যেন থমকে যায়। পরবর্তী সময়ে ঘুম স্টেশনের ইতিহাস ঘেঁটে অনেক তথ্য আরও ভাললাগার জন্ম দিয়েছে। সেই কবেকার কথা। যখন আমার জন্ম হয়নি। যখন ভারতবর্ষ পরাধীন ব্রিটিশদের হাতে। তখনই তৈরি হয়েছিল এই ট্রেনরুট। ইতিহাস বলছে, দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়েজের কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৭৯-তে। সেটা ঘুমে পৌঁছয় ১৮৮১-র ৪এপ্রিল। জানা যায় একটা সময় কলকাতা থেকে দার্জিলিং পৌঁছতে ট্রেনে করে সময় লাগত ৫-৬ দিন। তখন স্টিম ইঞ্জিনে চলত ট্রেন। ১৮৭৮-এ শেষ পর্যন্ত রেলের ম্যাপে জায়গা পায় শিলিগুড়ি। তার পর থেকে যাতায়াতটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
ইতিহাসের বেশি কচকচানি করে লাভ নেই। জানতে হলে ঘুম স্টেশনের পাশেই রয়েছে রেল মিউজিয়াম। সেখানে গেলে অনেক কিছু জানা যাবে। তবে ইতিহাসের থেকেও আমাকে বেশি আকর্ষন করে পরিবেশ, সেখানকার মানুষ, প্রকৃতি আর প্রাচীন স্থাপত্য বা আর্কিটেকচার। শিলিগুড়ি শহর থেকে বেরলেই সামনে খুলে যাবে উজার করে দেওয়া প্রকৃতি। একটার পর একটা স্টেশন কেমন একলা দাঁড়িয়ে রয়েছে জঙ্গলের মধ্যে। একদিকে জনমানবহীন ছোট্ট প্ল্যাটফর্মে সবুজ ফ্ল্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে স্টেশন মাস্টার অন্যদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে গজিয়ে উঠেছে নাম না জানা কত গাছ। যেখান থেকে ভেসে আসছে অজানা পাখির ডাক। একটু দাঁড়িয়েই আবার ট্রেন চলতে শুরু করবে।
শিলিগুড়ি জংশন থেকে ছাড়ার পর প্রথম স্টেশনের দেখা মিলবে ৯ কিলোমিটার দূরের ৫১১ ফিট উচ্চতার সুকনায়। যা ঘিরে রয়েছে মহানদী অভয়ারন্যে। তার পর মাত্র ৭ কিলোমিটার গেলেই এক লাফে পৌঁছে যাওয়া যায় ১৪০৪ ফিট উচ্চতার রংটংয়ে। এর পর ১২ কিলোমিটার পথ গেলে রয়েছে ২,৮২২ ফিট উচ্চতার তিনধারিয়া। প্রতিটি স্টেশনের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় হাজার ফিট করে উচ্চতায় উঠে গিয়েছে ট্রেন পথ। তিনধারিয়ার পর গয়াবাড়ির উচ্চতা ৩,৫১৬ ফিট। তার পর ৪,১২০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত মহানদী স্টেশন। এর পরই এক লাফে পৌঁছে যাওয়া কার্শিয়ংয়ে। যার উচ্চতা ৪,৮৬৪ ফিট। এর পরের স্টেশনের নামগুলো শুনলে অঞ্জন দত্তর সেই গানটা মনে পড়ে যাবে, ‘টুং, সোনাদা, ঘুম পেড়িয়ে’। কার্শিয়ংয়ের পর টুংয়ের উচ্চতা ৫,৬৫৬ ফিট। এর পর ৬,৫৫২ ফিট উচ্চতায় সোনাদা পেরিয়ে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ৭,৪০৭ ফিট উচ্চতার ঘুমে। ঘুমের পরই দার্জিলিং স্টেশন। কিন্তু আমি নেবে যাব ঘুমেই।
সেই ঘুম চোখে লেগে রয়েছে আজও। প্রথম দেখার ভাললাগা। এর পর শুধুই ঘুম স্টেশনে একলা হেঁটে বেরিয়েছি কতবার। দার্জিলিং স্টেশন থেকে টয় ট্রেনে চেপে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় ঘুমে। আর যাঁরা পাহাড়ে হাঁটতে ভালবাসেন তাঁরা হেঁটেও পৌঁছতে পারেন। আমি সব পথ ধরেই বার বার পৌঁছে গিয়েছি ঘুম স্টেশনে। শুধু কিছুটা সময় একান্তে কাটাব বলে। ছোট্ট স্টেশনের আনাচ-কানাচে লেগে রয়েছে অদ্ভুত এক মন কেমন করা অনুভূতি। কখনও সেখানে হাঁটতে হাঁটতে মন কেমন করে ওঠে। একলা মানুষের অপেক্ষায় থাকা বেঞ্চগুলো দু’হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানায়। সেখানে কিছুক্ষণ গা এলিয়ে দিই মনের সুখে। মেঘের দল ছুঁয়ে যায় চোখ, মুখ। তাদের হাতে ধরার বৃথা চেষ্টাও করি। কখনও হারিয়ে যাই মেঘের গহীনে। এই স্টেশনের এটাই বিশেষত্ব। মেঘেরা এখানে গাভীর মতো চরে। হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে যায়। চেপে ধরে শীত। দূর থেকে শোনা যায় ধুয়ো তুলে ধেয়ে আসা ট্রেনের হুঙ্কার। চাইলে তাতে উঠে পড়া যায় নিশ্চিন্তে। নেমে পড়া যায় পরের স্টেশনে।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google