সুচরিতা সেন চৌধুরী: রেল স্টেশনের (Train Station 1) একটা আলাদা আবেদন থাকে। আমাকে প্রতি যাত্রা পথের কোনও না কোনও স্টেশন আজও ভাবায়। তাঁর প্ল্যাটফর্ম, সেই প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা মানুষ, সেখান থেকে দূরে দেখতে পাওয়া স্কাইলাইন, প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছ—সব আকর্ষণ করে। মনে থেকে যায় সারাজীবন। প্রথম যখন বন্ধুদের সঙ্গে দিল্লি পাড়ি দিলাম তখন পূর্বা এক্সপ্রেসের জানলা দিয়ে প্রথম দেখা। দেখেছি হয়তো আগেও কিন্তু এভাবে নজর কাড়েনি। সেবার জানি না কী হল। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে হট শট ক্যামেরায় বন্দি হল কিছু ছবি। সালটা ১৯৯৭ হবে। সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করেছি। গন্তব্য শিমলা তবে দিল্লি হয়ে।
ঝাঝায় সেই সময় পূর্বা এক্সপ্রেস দাঁড়াতো না। রাজধানী এক্সপ্রেস বা দুরন্ত ছিল না। দিল্লি যাওয়ার জন্য ভাল ট্রেন বলতে পূর্বা। সেই সময় পূর্বা এক্সপ্রেসের প্যন্ট্রিকারের চিকেন ভাতের স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। এখন রাজধানীর খাবারও মুখে দিতে ভাবতে হয়। যাক সে সব কথা। আজকে বলব চোখে লেগে থাকা ঝাঝা স্টেশনের কথা। বিহারের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। দানাপুর ডিভিশনের পূর্ব প্রান্তের প্রান্তিক স্টেশনও বলা যায়। চারদিকে ধুধু প্রান্তর। আর সেই প্রান্তরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক ছোট-বড় টিলা। বর্ষাকাল হওয়ায় সেই পাথুরে টিলাও সেই সময় সবুজে ঢাকা। দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ জঙ্গল। এক অদ্ভুত পাহাড়, জঙ্গল, লালমাটির মিলন ঘটেছে এই ঝাঝার স্টেশন জুড়ে।
ট্রেনটা যখন ঝাঝা স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে তখনই ভাললাগা তৈরি হতে শুরু করেছিল। ফাকা প্রান্তর, চাষ জমির দৃশ্যপট ক্রমশ বদলাচ্ছিল। উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল পাহাড়। সে ছোট হলেও পাহাড় তো। আরা পাহাড়ের টান উপেক্ষা করে কার সাধ্যি। কিন্তু সেদিন ট্রেনটি ঝাঝায় দাঁড়ায়নি। কিন্তু পরেরবার দিল্লির পথে হঠাৎই একদম ঝাঝা স্টেশনেই দাঁড়িয়ে পড়ল ট্রেন। আর তা দেখে আমার আনন্দের শেষ নেই। সেবারও সেই বন্ধুরাই ছিল সঙ্গে। আগের বারের আমার আফসোস ওদের মনে আছে। তাই নেমে পড়লাম। জানা গেল সামনে লাইনে কোনও সমস্যা হয়েছে তাই ট্রেন ছাড়তে দেড়ি আছে। সবাই যখন দেড়ির জন্য বিরক্ত তখন আমি জমিয়ে উপভোগ করলাম ঝাঝা স্টেশন। এক বন্ধু আমার ঝাঝা স্টেশনের প্রতি প্রেম দেখে বলেই ফেলল, ‘‘চল নেমে পড়ি। এখানেই থেকে যাই তোর যখন এত পছন্দ।’’ কিন্তু থাকব কোথায়? ত্রিসীমানায় তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। স্টেশন চত্তরে ঘুরে বেড়ানো একজনের থেকে হোটেলের খোঁজও নেওয়ার চেষ্টা হল কিন্তু তিনি হতাশ করলেন। পাগলামোটা এমনই ছিল সেই সময়।
প্ল্যাটফর্মের কয়েক হাতের মধ্যে দিয়েই উঠে গিয়েছে পাহাড়। তার অনেকগুলো পাথুরে হলেও অনেকগুলো বেশ জঙ্গলে ভর্তি। ধান জমি পেরিয়ে সেই টিলার মাথায় চড়া যায়। খুব ইচ্ছে থাকলেও সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। স্টেশনের তখন দখল নিয়েছে দাঁড়িয়ে পড়া পূর্বা এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। মনে আছে পুরো স্টেশন চত্তরে একটিও দোকান চোখে পড়েনি সেই সময়। এক, দু’জন ভাড়ের চা আর ছোলা সেদ্ধ ঝুড়িতে নিয়ে ঘুরছিল। কেউ কেউ সেটাই খাচ্ছিল সময় কাটাতে। আমরাও চায়ে চুমুক দিলাম। স্টেশন চত্তর ছেড়েই শুরু লাল মাটির জমি। রুক্ষ এই জমিতে ফসল ফলে দেখে অবাক লাগল। চাষ হচ্ছে। কিন্তু সব কিছু টপকে আমার নজরে শুধু ওই টিলাগুলো। ‘‘ওর ওপরে যদি একটা বাড়ি হত?’’ এমন স্বপ্ন এই লম্বা জীবনে অনেক জায়গা দেখেই মনে হয়েছে। তা বলে ঝাঝা?ঝাঝালো জবাব এল পাশ থেকে। হলই বা সে ঝাঝা, ভাললাগার তো আর কোনও ভূগোল থাকে না।
ইতিহাস বলছে ১৮৬২ সালে দিল্লি-কলকাতাকে ট্রেন পথ মেলাতে কিউল-পাটনা রুটের এই রেললাইন তৈরি হয়। ১৮৬৪ থেকে এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তার পর থেকে কলকাতা ও দিল্লির মধ্যে সরাসরি যাতায়াত করা সম্ভব হয়। না হলে ব্রেক জার্নি করতে হত। এখন এই ঝাঝা স্টেশন অনেক বদলে গিয়েছে। অনেক দূর পাল্লার ট্রেন এখানে দাঁড়ায়। তৈরি হয়েছে ওয়েটিংরুম, পার্কিং, টেলিফোন বুথ, এটিএম কাউন্টার, দোকান। সেই সময় কিছুই ছিল। মনে হত একটা পরিত্যক্ত স্টেশন হঠাৎ জেগে উঠেছে লাইন বিভ্রাটে। আমাদের ট্রেন ছেড়ে গেলে এই স্টেশনও গায়েব হয়ে যাবে। অথবা দিনের পর দিন একলা দাঁড়িয়ে এভাবেই বিভ্রাটের অপেক্ষায় থাকে ঝাঝা স্টেশন। তখন যদি অনেক মানুষের পা পড়ে।
মনে পড়ছে, সেটাও বর্ষাকাল ছিল। মাঝে মাঝেই টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। ভেজা প্ল্যাটফর্ম চত্তরে ছড়িয়ে ছিল গাছ থেকে পড়ে যাওয়া ফুল। হাওয়ায় একটা ঠান্ডা ভাব ছিল। টিলাগুলোর সবুজ যেন মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টির জলে গাঢ় হয়ে উঠল চোখের সামনে। ওই পাহাড়ঘেরা গ্রাম্য স্টেশন চত্তরে দু-এক ফোটা বৃষ্টির জল গায়ে মেখে নিলেই বা ক্ষতি কী। ভাললাগা তো ছিলই তা যেন দ্বিগুন হয়ে গেল। বৃষ্টি প্রেমের এটাই তো মহিমা। প্রায় ১ ঘণ্টা ট্রেন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। একটুও বিরক্ত লাগেনি। বরং ভাল লাগছিল। মনের শান্তি, চোখের আরাম হচ্ছিল চারদিক দেখতে দেখতে। তার পর একটা সময় এল, বিদায় জানাতে হল ঝাঝা-কে। মন্থর গতিতে আমাদের পূর্বা এক্সপ্রেস ঝাঝাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল গন্তব্যের দিকে। তখনই বিকেল নামল। গোধূলীর আলোয় মায়াবী টিলায় স্বপ্নের বাড়িটা যেন খালি চোখেই দেখতে পেলাম শেষবারের মতো।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google