সুচরিতা সেন চৌধুরী: ক্লান্ত থাকলেও ঘুম ভেঙে গেল সকাল সকালই। যেমনটা ঠিক পাহাড়ে হয়। ঘুম ভাঙতেই গত রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু সেই সব চিন্তাকে পিছনে ফেলে নেমে পড়লাম বিছানা থেকে। বেশ ঠান্ডা বন্ধ ঘরের মধ্যেই টের পাচ্ছি। অত রাতে, বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকেছিলাম তাই ঘরটা কেমন সেটাও বুঝে উঠতে পারিনি। রাতে যখন হোটেলে ঢুকি তখন পুরো মানালি অন্ধকার, আমাদের হোটেলেও ছিল না স্বাভাবিকভাবেই। তাই ঘরটাই দেখা হয়নি। ঘুম ভেঙে দেখলাম পুরো ঘরটার তিনদিক পর্দায় ঢাকা। পুরোটা পর্দা দেখে অবাকই লাগল। উঠে একটা পর্দা সরাতেই শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না (Manali Morning)। পুরো ঘরটার তিনদিকই কাচের দেওয়াল। মুগ্ধতার এখানেই শেষ নয়। একটা করে পর্দা সরাচ্ছি আর অবাক হচ্ছি। প্রকৃতি যেন ওই জানলার বাইরে নিজের সব ভালোর ডালি সাজিয়ে বসে রয়েছে শুধু আমারই জন্য।
মনে হচ্ছিল এর পর আর কী চাই? এই তো সব পেয়েছির দুনিয়া। আর জীবনে কিছু না পেলেও চলবে। কোথাও না গেলেও চলবে, বৃষ্টিতে ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলেও আপত্তি নেই। আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল আমার দলের বাকিদেরও। লেপের তলা থেকেই ওদের চোখ বলে দিচ্ছে আমার মতই অনুভূতি ওদেরও। ঘরের এক একটা জানলা যেন এক একটা সিনেমার পর্দা। ও বলে রাখি বৃষ্টি কিন্তু কমেনি। তেজ কমলেও পড়েই চলেছে। ফোন করে চায়ের অর্ডার দিয়ে জানলায় চোখ রাখলাম। মানালি যে আপেলের জায়গা তা হোটেলের ঘর থেকেই টের পেলাম। জানলার বাইরেই আপেল গাছ। প্রবল বৃষ্টিতে গাছ থেকে পড়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে কত আপেল। কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না আর কলকাতায় আপেলের কী দাম!
দরজায় ঠক ঠক শব্দে সম্বিত ফিরল। চা নিয়ে হাজির। সঙ্গে বিস্কুট। খুব দরকার ছিল চা। তবে দুঃসংবাদ শোনাল হোটেলের ছেলেটি। বুঝতে পারলাম আজ আর রোটাংপাস যাওয়া হবে না। জানা গেল, রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, ধস নেমে রোটাংয়ের একধিক জায়গায় রাস্তা বন্ধ। রোটাং যাওয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। আজ আর বৃষ্টি যদি না হয় তাহলে পরদিন খুলতে পারে রোটাংয়ের রাস্তা। গাড়ির চালক এসেও সেই খবর দিয়ে গেলেন। ভালই হল, আজ সারাদিন এই জানলাতেই কেটে যাবে সময়। চা নিয়ে আবার জানলায় এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি চললেও আকাশ খানিকটা পরিষ্কার হচ্ছে। আর তখনই চোখের ফ্রেমে ধরা দিল বরফ ঢাকা পাহাড়। তার সামনেই বয়ে চলেছে খরোস্রোতা বিয়াস। কুলুতে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখানে যেন সে আরও উগ্র।
বৃষ্টির বিরাম নেই। লেপের তলায় এসে বসলাম। এমন ঘর হলে আর বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। আলু পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্টটাও ভালই হল। বোঝাই যাচ্ছে আজ এই ঘরেই কেটে যাবে দিনটা। লাঞ্চটা এদিন জমিয়েই হল। গোটা দিনে আগের দীর্ঘ জার্নি আর টেনশনের ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। মনও ফুরফুরে। বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা একটু কমতেই বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন অনেকেই। সকলের মুখেই গত রাতের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা। প্রথমেই ঘুরে এলাম মানালির হারিম্বা দেবী মন্দিরে। মানালির বিখ্যাত এই মন্দির ঘিরে রয়েছে অনেক মিথ। যা নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। বরং এই মন্দিরের আশপাশের পরিবেশ অসাধারণ। শান্ত, পাইনের জঙ্গল। আলো-আধারি। সঙ্গে মন্দিরের আর্কিটেকচার। সবটাই মুগ্ধ করবে।
সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মানালির উপকণ্ঠে। যেখানে পুরো একদিন পর দোকান-বাজার খুলেছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি কিছু ট্যুরিস্টেরও ভিড় দেখা গেল। আমরা ভিড় এলাকা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম বিয়াসের পাড় ধরে অনেকটা আগে। যেখানে দোকান, বাজারের ভিড় নেই। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হতেই নদীর পাশেই একটি কাফেতে আশ্রয় নিলাম। অসাধারণ সুন্দর তার পরিবেশ। নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বিয়াস সঙ্গে গরম গরম কফি আর চিকেন পকোড়া দারুণ জমে গেল। নদীর পাশের কাফেতে বসে সান্ধকালীন স্ন্যাক্স খেতে খেতে অন্ধকার নামল। আগের রাতটা এতটাই অন্ধকার ছিল বুঝতেই পারিনি। তবে এই রাত অসম্ভব রোমান্টিক। পুরো মানালির পাহাড় জুড়ে জ্বলে উঠেছে আলো। যেন পাহাড়ের গায়ে লেগে রয়েছে জোনাকি। বাজারে হরেকরকম পসরা সাজিয়ে বসেছেন স্থানীয়রা।
শিমলার থেকে এখানকার মার্কেট অনেকটাই সস্তা। তাই কিছু কেনাকাটি হল। আমার মনে আছে স্থানীয়দের হাতের সুতোর কাজের দুটো চুরিদার পিস কিনেছিলাম আমার আর বোনের জন্য। দীর্ঘদিন সেই চুরিদার পরেছি আমরা যা আমাকে বার বার মানালির সেই দিনগুলোর কথা মনে করাত। কেনা শেষে আরও কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম মানালির রাস্তায়। ওখানে বাজারে পাশেই রয়েছে একটি গুম্ফা। সেখানে রয়েছে বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি। সেটাও ঘুরে এলাম হাঁটতে হাঁটতে। এখানে বলে রাখি, মানালির ঠান্ডা কিন্তু জাঁকিয়ে পড়েছে বৃষ্টি থামার পর। ভাগ্যিস শিমলা থেকে গরম পোষাক কেনা হয়েছিল। তবে জানা গেল এই পোষাকে রোটাং যাওয়া যাবে না। পথে ভাড়া করতে হবে।
রাত বাড়তে মানালির রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। আমরাও ফিরে গেলাম হোটেলে। হোটেলের ঘরে পৌঁছে আর এক প্রস্থ চা সহযোগে জমে উঠল আড্ডা। সেই সকালের পর থেকে ঘরের জানলার পর্দা একবারও আর টানা হয়নি। ঘরের আলো নিভিয়ে দিলে সামনে শুধু অনন্ত অন্ধকারের মাঝে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ছোট ছোট আলোর রোশনাই দেখা যাবে। ডিনার দিতে এসে হোটেলের ছেলেটি জানালো, মনে হচ্ছে কাল রোটাং পাসের রাস্তা খুলে যাবে। আর বৃষ্টি হবে না। কিছুটা স্বস্তি পেলাম। এত কাছে এসে রোটাং না দেখে ফিরে যেতে হবে ভাবলে একটু খারাপ লাগছিল বৈকি। যাক তাহলে রোটাং দেখা হচ্ছে। যা পেরিয়ে কিছুটা গেলেই লাদাখ। যা আজও যাওয়া হয়নি। কবে হবে জানি না। রাতে শুয়ে শুয়ে লাদাখের প্ল্যানটাও সেরে ফেললাম। বাইরে তখন আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বুঝতে পারলাম মেঘ নেমেছে নিচে। কাঁচের জানলা কেমন ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে। কিন্তু পর্দা টানানো যাবে না কারণ চোখ খুলেই মানালির সকাল দেখতে চাই। তার পরই দে ছুট রোটাং।
ছবি—লেখক ও সংগৃহিত
(পঞ্চম পর্ব)
Way To Manali: বৃষ্টি, ধসে অল্পের জন্য রক্ষা, চতুর্থ পর্ব
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google