কতটা পথ পেড়লে তবে পথিক বলা যায়? এই প্রশ্নটা সারাক্ষণই ঘোরে মনে, মাথায়। আদৌ কি আমি পথিক? নাকি শুধুই সুখি ভ্রমণার্থী (Sandakphu Trekking 3)। তবে যাই হই না কেন সব চিন্তাকে পিছনে ফেলে প্রকৃতির টানে বেরিয়ে পড়তে কার না ভাল লাগে। যেন সেই স্বপ্নই বুনতে থাকে মানুষ দিনের পর দিন। তার পর একদিন হঠাৎ করে সুযোগটা চলে আসে। আসলে মন থেকে চাইলে একদিন স্বপ্নটা সত্যি হয়। গত দু’বছর গৃহবন্দি থাকা মানুষ আবার নতুন করে ডানা মেলতে শুরু করেছে। ঘর ছেড়ে কেউ পরিবার, কেউ বন্ধু আবার কেউ একাই বেরিয়ে পড়েছে চেনা গণ্ডির বাইরে। তার আগে একটু স্মৃতির পাতা উল্টে দেখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী।
বাড়ির মালকিন এসে কেমন আছি জানতে চাইলেন। আদা-গোলমরিচ দিয়ে চা বানিয়ে আনলেন। সঙ্গে ব্রেক ফাস্টে লুচি-আলুর তরকারি। চা-টা খুব কাজে লাগল। আমার জ্বর নেই দেখে টিমও স্বস্তিতে। কিন্তু দুর্বলতা রয়েছে, সেটা আমি ভালই টের পাচ্ছিলাম। তবে ল্যান্ডরোভারে উঠবো না সেটা ঠিকই করে নিয়েছিলাম। তাই ঠিক হল দু’জন আমার সঙ্গে হাঁটবে আর বাকিরা এগিয়ে যাবে। সেই দলটা আগেই রওনা দিল। আমরা একটু পরে। ধিরে সুস্থেই হাঁটা শুরু করলাম। মুশকিল হল অন্য জায়গায়। আমাদের সঙ্গে গাইড একজন। দুটো টিম হয়ে যাওয়ায় যে দলের সঙ্গে গাইড থাকবে না তারা রাস্তা হারাতে পারে। গাইডই রাস্তা বাতলে দিলেন। তিনি জানালেন বেশিরভাগটাই সোজা রাস্তা। প্রথম দলকে ছেড়ে তিনি আবার ফিরে আসবেন। মাঝ পথ থেকে আমাদের নিয়ে যাবেন। শুনে আমরাও স্বস্তি পেলাম।
হাঁটা শুরু হল। এদিনের ডেস্টিনেশন সান্দাকফু। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম স্থান। ১১৯২৯ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত সান্দাকফু নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি এত বছর। শেষ পর্যন্ত যাচ্ছি। এটা ভেবেই দুর্বল শরীরেও এনার্জি আসতে শুরু করল। এদিনের আবহাওয়া কিছুটা মেঘলা। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভাড়। বৃষ্টি যদিও হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই জানালেন স্থানীয়রা। তবে একটাই স্বস্তি, সান্দাকফুতে আমরা দু’দিন থাকবো। গত তিনদিন প্রচন্ড দৌঁড়-ঝাঁপ হয়েছে। এবার একটু বিশ্রাম চাই। তাই ধিরে-সুস্থে হেঁটে অন্ধকার নামার আগে পৌঁছতে পারলেই হল। সত্যিই আমরা যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর-আর বিকেলের মাঝখানে থমকে রয়েছে সময়। মেঘগুলো কিছুটা নেমে এসেছে পাহাড়ের চূড়া থেকে। ক্রমশ সরে যাচ্ছে ঘুমিয়ে থাকা বুদ্ধের চাদর। এই সেই স্লিপিং বুদ্ধ!
Sandakphu Trekking 2: স্মৃতির পাতা থেকে, টুমলিং টু কালিপোখড়ি
একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি ঘুমন্ত বুদ্ধের দিকে। আগে তো অনেকবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। কিন্তু এমন অনুভূতি? না হয়নি। যেন এখনই জেগে উঠবে ওই বরফের বুদ্ধ। হাত বাড়ালেই মনে হচ্ছে ধরতে পারব। যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি তার সামনে মেঘের ভেলা তৈরি। ভেসে পড়লেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ওই পাহাড় চূড়ায়। এতদিন উপরদিকে মাথা তুলে দেখতে হয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর আজ সব থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলা যাচ্ছে। এই অনুভূতির জন্যই তো এত কষ্ট করা। এত দূর হেঁটে পাড়ি দেওয়া। মুগ্ধতা থেকে নিজেকে উদ্ধার করে মাঝে আমরা সকলে লাঞ্চ সেরে নিয়েছি। সান্দাকফুতে থাকার জায়গাটি সরকারের। তাই ব্যবস্থাও ভাল। আগেই বলেছিলাম, এখানে ফোন রয়েছে। জানা গেল এতদিন খারাপ হয়ে পড়েছিল ফোনের লাইন। আজই ঠিক হয়েছে। দু’দিন পর আবার বাড়িতে সবার কুশল সংবাদ জানানো হল।
লাঞ্চ করতে করতেই বিকেল হয়ে গেল। তার পর কিছুটা হেঁটে বেড়ানো এদিক ওদিক। কেউ টিলার উপর উঠে ছবি তুলল। আমিও বাদ গেলাম না। জ্বরের রেশমাত্র নেই। দুর্বলতাও গায়েব। যদিও বন্ধুরা মঝে মাঝেই সাবধান করল। ফেরার পথে ট্রেকিং বেশ খানিকটা কঠিন। এবং দীর্ঘ। এবং সে পথে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। ল্যান্ডরোভারও চলে না। লনের সুবজ গালিচায় বসে, সামনে মেঘ, পাহাড়, সূর্যের খেলা দেখতে দেখতেই কেটে গেল দিন। সূর্য অস্ত গেল স্লিপিং বুদ্ধের শরীর ছুঁয়ে। বরফ সাদা বুদ্ধের গায়ে তখন যেন কে লাল রঙ ঢেলে দিয়েছে। দিনের মতো সূর্য বিদায় নিতেই মেঘের দল আবার উঠে ঢেকে দিল বুদ্ধের শরীর। অদ্ভুত যেন নিয়মে বাঁধা প্রকৃতির এই কর্মকাণ্ড। অন্ধকার নামতেই জাঁকিয়ে পড়ল ঠান্ডা। তবে তুষারপাতের কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই জানাল এলাকার লোকজন।
রাত বাড়তে তাপমাত্রার পারদ মাইনাস ছুঁই ছুঁই। লেপের বাইরে বেরলেই জমে যাওয়ার জোগার। তার মধ্যেই ডিনার সেরে নিতে হল। এদিন আর বেশি আড্ডা না দিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। কারণ পরদিন আবারও ভোর রাতে উঠতে হবে যদি সূর্যদয় দেখতে হয়। আর বাংলার সর্বোচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের অপরূপ শোভা না দেখাটা বোকামি। মাথার কাছের জানলাটা দিয়ে দুপুরেই দেখেছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা অংশ দেখা যায়। তাই পর্দাটা সরিয়েই শুলাম। ঘুম ভাঙলেই দেখে নেব সূর্যদয় শুরু হল কিনা। পূর্ণিমা থাকলে সারারাত চাঁদের আলোয় তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়। তবে যতদূর মনে পড়ছে তখন পূর্ণিমা ছিল না। দিনের আলোয় বার বার দেখব। আফশোস নেই। বাকি দুটো জায়গায় শুধু আমরা থাকলেও সান্দাকফুতে আরও একটি ট্রেকার পার্টির সঙ্গে দেখা হল। সকালে ওদের কলকাকলিতেই ঘুম ভাঙল আমাদের।
যত গরম জামা-কাপড় ছিল সব জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। বাইরে তখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। জমে থাকা সব জল বরফ হয়ে গিয়েছে। তা দেখেই আমাদের কী আনন্দ। কুয়াশা জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। তখনও সূর্যিমামা উদয় হওয়া শুরু করেননি। ঝাপসা দেখা যাচ্ছে স্লিপিং বুদ্ধ। সবার দৃষ্টি তখন তুষার শৃঙ্গের দিকে। হঠাৎই দেখলাম সব থেকে উঁচু অংশের মাথাটার রঙ বদলাতে শুরু করল। তার পর একটু একটু করে সেই লাল আভা গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে লাল রঙে রাঙিয়ে তুলল পুরো তুষার শৃঙ্গকে। পিছন ফিরে দেখি লাল আগুনের গোলা তখন স্থির দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মাঝ আকাশে গিয়ে হারিয়ে গেল। স্লিপিং বুদ্ধও তখন গায়ের সব লাল রঙ ঝেড়ে আবার পুরনো রূপ ফিরে পেয়েছে।
(চতুর্থ পর্ব আগামীকাল)
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)