সুচরিতা সেন চৌধুরী: বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশিরবিন্দু।
সেই কবে লিখে গিয়েছেন কবি যা আজও বড্ড প্রাসঙ্গিক। সত্যিই তো আমরা কোথায় কোথায় ঘুরতে চলে যাই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের প্রকৃতির কাছে। কিন্তু একটু চোখ মেলে নিজের চারপাশে তাকালেই দেখা যাবে হাতের কাছেই রয়েছে সেই আরশিনগর। সেই প্রকৃতি। ভাললাগার আস্তানা। আর সেই শিশিরবিন্দুর খোঁজেই গত ২৫ ডিসেম্বরের সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম এক বন্ধুকে সঙ্গে করে। গন্তব্য সাঁতরাগাছি ঝিল। অতীতে বহুবার শুনেছি এই ঝিলের কথা, যেখানে শীতের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির দল ছুটে আসে। বেশ কিছুটা সময় কাটায় আবার ফিরে যায় যার যার আস্তানায়।
পাখির ছবি তোলার শখ মাথাচাড়া দেওয়ার পর সেই সাঁতরাগাছি ঝিলে না যাওয়াটাই অপরাধ। আমার এক পাখি বিশেষজ্ঞ দাদা বলেছিলেন, সকাল সকাল চলে যেতে আর বিকেল পর্যন্ত থাকতে। সত্যি তাঁর কথা মেনে দেখলাম প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে বদলে যায় পাখিদের ব্যবহার। গোটা ঝিলটাকেই ঘিরে রয়েছে রাস্তা। হেঁটে হেঁটে বা টোটোতে চেপে ঘোরা যায় একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। তবে হেঁটে ঘোরার মজাই আলাদা। ক্যামেরা তাক করে পাখির কীর্তিকলাপ ফ্রেমবন্দি করা যায় সহজে।
প্রথমেই যাদের সঙ্গে দেখা হল তারা লেজার-হুইসলিং ডাক। ওদেরই রাজত্ব গোটা ঝিল জুড়ে। একটা সময় পর্যন্ত মনে হচ্ছিল অন্য কারও নো-এন্ট্রি এই দুনিয়ায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই ধরা দিল। লেজার হুইসলিং ডাকের অনবদ্য সোনালি রঙ আকর্ষনীয়। ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে জলে। আবার অনেকেই গা ঘষাঘষি করে বিশ্রাম নিচ্ছে জলের মাঝে মাঝে তৈরি হওয়া ছোট ছোট দ্বীপে। সুযোগ বুঝে জলে একটা ডুব দিয়ে আবার উঠে যাচ্ছে পাড়ে। সে এক অনবদ্য দৃশ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওদের এই অবাক বিচরণ দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
সোনালি হাঁসের মধ্যে দিয়েই মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল ইন্টারমিডিয়েট এগ্রেট। সাদা হওয়ায় যেন সহজেই ধরা পড়ছিল চোখে। ওদের দেখলাম বেশি সময়টা কাটাচ্ছে জলের মধ্যে তৈরি হওয়া কচুরীপানার জঙ্গলে। ওদের পাশাপাশিই ঘুর ঘুর করছিল কিছু ইন্ডিয়ান পন্ড হেরন। একজন তো গোল গোল চোখ করে আমাদের দিকে তাঁকিয়ে ছিল। এই দুই প্রজাতিকে আমি অতীতেও এক সঙ্গে দেখেছি। ডোরাকাটা গা দেখে বেশ ভয় ভয় লাগে। এই বুঝি আক্রমণ শানাল। কিন্তু না ওরা বড্ড শান্ত। নিজের মতো জলকেলিতেই ব্যস্ত।
তা বলে সবার সঙ্গে যে জলেই সাক্ষাৎ হয়েছে তেমন নয়। ঝিলের চারদিক ঘিরে থাকা গাছের আনাচ-কানাচ ভাল করে দেখলে দেখা হয়ে যেতে পারে অচেনা, অদেখা পাখির সঙ্গে। হঠাৎই যেমন ফুলের ছবি তুলতে গিয়ে চোখে পড়ে গেল গাছের একদম মাথায় ফুলের উপর বসে থাকা চেস্টনাট টেইলড স্টার্লিংয়ের সঙ্গে। এছাড়া বাঙালির বুলবুল পাখি আর বাংলার মাছরাঙা (হোয়াইট থ্রোটেড কিংফিশার), পান কৌরি (ইন্ডিয়ান কর্মোরেন্ট) তো ছিলই। ইন্ডিয়ান কর্মরেন্ট যে গাছে আস্তান তৈরি করে সেখানে গাছের পাতা দেখা যায় না, এক সঙ্গে এত থাকে। বাড়ির পাশে এদিক ওদিক চোখ রাখলে সহজেই ওদের সবার দেখা পাওয়া যায়।
দিনের শেষে ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল ব্রোঞ্জ উইংড জাকানার সঙ্গে। ভাগ্যিস আমার বন্ধুটি দেখেছিল। কচুরীপানার মধ্যে ঘাপটি মেরে বসেছিল সে। আমাকে ছবি তোলার জন্য অনেকটাই সময় দিল। মন ভড়ে গেল সাঁতরাগাছির ঝিলে সূর্যাস্ত দেখে। যেন মনে হচ্ছিল ঝিলের জলে কেউ সোনার জল মিশিয়ে দিয়েছে। আকাশে তখন থমকে গিয়েছে সূর্য। তার সঙ্গেই জল ছেড়ে আকাশে উড়ছে পাখির দল। সেও এক অনবদ্য দৃশ্য। দিনের শেষে ঘরে ফেরার পালা আমাদেরও। প্রকৃতির মধ্যে সকাল থেকে রাত কেটে গেলেও ক্লান্তি নেই কোনও। শহরের রাস্তায় তখন বড়দিনের উৎসব। আমার উৎসব তো প্রকৃতির সঙ্গেই।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google