পাকিয়ং, সিকিমের এই ছোট্ট জনপদে সেদিন সাঁতার কেটেছিলাম মেঘের সমুদ্রে

পাকিয়ং

পাকিয়ং নামটার সঙ্গে এখন সবাই পরিচিত সিকিমের একমাত্র বিমানবন্দরের জন্য কিন্তু আমার কাছে পাকিয়ং অন্য একগুচ্ছ অভিজ্ঞতা। বহু বছর ধরে বহু পাহাড়ি শহর, গ্রাম, জনপদ দেখেছি। সেখানে থেকেছি, সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছি। অদ্ভুত মনে থাকার মতো দৃশ্য দেখেছি যা হয়তো সারাজীবনে একবারই দেখা যায়। এক পাহাড়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ ওঠা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। এতদিন সূর্যোদয় দেখেছি কিন্তু চন্দ্রোদয়! হিমাচলের এক পাহাড়ি জনপদে এক পূর্ণিমার রাতে এত বড় চাঁদ দেখেছিলাম যা আর কখনও দেখতে পারব কিনা জানি না। এমনই এক অভিনব অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন সুচরিতা সেন চৌধুরী


আমার মেঘ বড্ড পছন্দ। পাহাড়ে মেঘলা আবহাওয়া দেখলে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন কিন্তু আমি উচ্ছ্বসিত হই। বিভিন্ন জায়গায় মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতেই ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো ট্যুরটা। মেঘ সরিয়ে হেঁটে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তায়। এক কথায় হারিয়ে যাওয়া। সামনে পিছনে যত মানুষই থাক না কেন কেউ দৃশ্যমান নয়।

অনেক ভনিতা হয়েছে এবার আসি আসল কথায়। এমন মেঘের রাজত্ব দেখেছিলাম একবার যা আর কখনও দেখিনি। পূর্ব সিকিমের ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ পাকিয়ং। স্থানীয় ভাষায় পাকিম। যদিও বিমান বন্দর হওয়ার পর পাকিয়ং আর ছোট্ট জনপদ নেই। কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলছিল সেই সময় পাকিম ছিল আমার ভালবাসার পাহাড়ি গ্রাম। বেশ কয়েকবার গিয়েছি।

সেবার যখন পৌঁছেছিলাম তার আগে থেকেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সিকিম জুড়ে। যে বাড়িটায় থাকতাম তার ঠিক সামনের পাহাড়ে বিশাল ধস নেমেছিল। মূল রাস্তা টপকে  কিছুটা এগোলে এত বড় ধস নেমেছিল যে রাস্তাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। পুরো একটা পাশের পাহাড় ভেঙে পড়েছিল। সেই সময়ই আমরা সপরিবারে সেখানে পৌঁছই। মা, বোন, মাসি, মেসো আর আমার বন্ধু রবি। লোক বেশি হয়ে যাওয়ায় এক বাড়িতে থাকা সম্ভব হত না। সে কারণে কিছুটা দূরে বোনের এক কলিগের বাড়িতে আমরা ক’জন শুতে যেতাম।

সেদিনও সকাল থেকেই বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল থেকে সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়ে গেলেও বৃষ্টি থামার কোনও নাম নেই। বরং প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। একটা আতঙ্কও কাজ করছে পাশাপাশি। এই বৃষ্টিতে আরও ধস নামার সম্ভাবনা। সামনের পাহাড়টা থেকে মাঝে মাঝেই চাঙড় খসে পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রাতে মা খিচুড়ি আর অমলেট বানিয়েছিল। খাওয়াটা দারুণ হল। বৃষ্টিতে এর থেকে আর উপাদেয় কী হতে পারে। কিন্তু ও বাড়িতে শুতে যাব কী করে?

পাহাড়ে রাত তাড়াতাড়ি হয়। ততক্ষণে গোটা পাহাড় ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তায় মাঝ মাঝে হেঁকে চলেছেন ময়লাচাচা। আর ত্রিসীমানায় কেউ নেই। ময়লাচাচার গল্প অন্য কোনও দিন বলব। আচ্ছা এখানে বলে রাখা ভাল, পাকিয়ং-এর উচ্চতা অনেকটাই কম। খুব ঠান্ডা থাকে না। অবস্থান অনুযায়ী উল্টোদিকে গ্যাংটক শহর। রাতের আলো জ্বলে উঠলে দিওয়ালি মনে হয়। এ দিন বৃষ্টির কারণে তাও দেখা যাচ্ছে না।

জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে মনে হল একটু কমেছে। এই সুযোগে বেরিয়ে পড়তে হবে। সঙ্গে একটা করে বাড়তি ড্রেস রাখতে হল। এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি পৌঁছতে নির্ঘাত ভিজে যাব। সব কিছু প্লাস্টিকে মুড়ে মাথায় ছাতা দিয়ে হাঁটা লাগালাম। দু’পা এগোতেই বুঝলাম এই ছাতা কোনও কাজে লাগবে না। তার উপর হাওয়া, বৃষ্টির তীব্রতা সব এক হয়ে তখনই ভিজে গিয়েছি সবাই।

কোনও রকমে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে মা-র ফোন। মাসির প্রেসারের ওষুধ থেকে গিয়েছে মেসোর ব্যাগে। আর মেসো সেই ব্যাগ নিয়ে আমাদের সঙ্গে এই বাড়িতে চলে এসেছে। প্রেসারের ওষুধ না খেলেও চলবে না। তাই সেই অসুধ নিয়ে ভিজে অবস্থাতেই রওনা দিলাম আমি আর রবি। কিছুটা জায়গায় রাস্তার আলোগুলো জ্বললেও বেশিরভাগ জায়গাতেই জ্বলছে না। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চের আলো যেন কোনও কাজই করছে না। প্রবল জোরে শুরু হয়েছে বৃষ্টি।

যাওয়ার পথেই দেখেছিলাম আমাদের পায়ে পায়ে চলছে মেঘের দল। বৃষ্টি থেমে গেলে সাধারণত মেঘ জমা হতে দেখেছি পাহাড়ে বা বৃষ্টির আগে। কিন্তু মেঘ-বৃষ্টি এক সঙ্গে কমই দেখা যায়। ওষুধ দিয়ে সময় নষ্ট না করে রওনা দিলাম। ওই বাড়ি থেকে একটা রাস্তা বাঁক খেয়ে হঠাৎ করেই উঠে গিয়েছে অনেকটা উপরে। বেশ চড়াই। সেই পথে বাঁক নিতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি আর রবি।

‘একি রে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না’, বলে উঠল রবি। কয়েক সেকেন্ড এটা ভাবতে সময় লাগল কী ভাবে ওই পথে এগোব। পাহাড়ি পাথুরে রাস্তা। এক হাত দূরে সরে গেলে আমরা একে অপরকে দেখতে পাচ্ছি না। আতঙ্ক কাটাতে কিছুটা সময় লাগল ঠিকই কিন্তু আতঙ্ক কাটতেই অদ্ভুত একটা ভাললাগা গ্রাস করল। প্রতিটি স্টেপে মেঘের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলাম। সত্যি বলছি, আমি মেঘের গন্ধ পাই। জানি না আর কেউ পায় কিনা। অনেককেই বলেছি সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।

মেঘের সমুদ্রে রীতিমতো সাঁতার কাটতে হল আমাদের। ১০-১৫ মিনিটের রাস্তা আমরা পার করলাম প্রায় এক ঘণ্টায়। আর পুরো রাস্তাটাই মেঘ সরিয়ে সরিয়ে। টর্চের আলোয় মেঘ ধরা দিচ্ছে সাদা রেখা হয়ে। হাতে, মুখে, পায়ে, গায়ে জড়িয়ে থাকল মেঘের দল পুরো রাস্তা। এমন মেঘ এর আগে কখনও দেখিনি। এত ঘন মেঘ, যা হাতের মুঠোয় ধরা যায়।

রাতে ঘুমের মধ্যেও বার বার ঘুরে ফিরে এল সেই মেঘ, সেই অদ্ভুত সুন্দর কিছুটা আতঙ্কের মেঘ। সকালে আকাশের মুখ ভার থাকলেও অত মেঘ আর দেখিনি। তার পরও অনেকবার গেছি পাকিয়ং-এ কিন্তু এমন মেঘ আর কোথাও দেখিনি। এমন মেঘ দেখিনি মেঘালয় বা মেঘমা কোথাও। মেঘের জন্যই তো এমন নাম এই দুটো জায়গার। কিন্তু আসল মেঘের আলয় দেখেছিলাম সেদিন পাকিয়ং-এ। না সেই ছবি আমার কাছে নেই। তখন মোবাইলে ক্যামেরা ছিল না।

পাকিয়ং নিয়ে আরও অনেক লেখা যায়। গ্রামের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো। কাতোর্ক গুম্ফা, গুম্ফার পিছনের সেই অধরা জঙ্গল। যেখানে চোখের সামনে দেখেছিলাম বাজ পড়তে। এটাও একবারই দেখেছি। আলোটা কীভাবে গাছের ফাঁক গলে সাপের মতো নেমে এল মাটিতে। সব সৌন্দর্য্যেরই একটা ভয়ঙ্কর দিক থাকে। পরে ভাবলে যা রোমাঞ্চ তৈরি করে।

ছবি: সুচরিতা সেন চৌধুরী

(প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে)

(জাস্ট দুনিয়ার ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন)