নেপালের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, যখন বর্তমান সরকারে বিরুদ্ধে উত্তাল দেশ, তখন প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি আবার রাজতন্ত্র ফিরবে দেশে? তার সঙ্গেই দ্বিতীয় প্রশ্ন, কোথায় রাজপরিবারের জীবিত প্রতিনিধিরা? তাঁরা কি এই দায়িত্ব নিতে রাজি? তবে তার আগে একবার চোখ রাখা যাক নেপাল রাজপরিবারের একমাত্র স্মৃতি Narayanhiti palace-এর দিকে—
নারায়ণহিটি একদম কাঠমান্ডু শহরের মাঝখানে অবস্থিত, তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে নেপালের রাজধানী শহর। কয়েক দশক ধরে, এটি নেপালের রাজতন্ত্রের কেন্দ্র ছিল – জমকালো অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় ভোজ, ঝাঁচকচকে পারিবারিক জীবন ছিল দেখার মতো। কাঠমান্ডুতে বেড়াতে গেলে সেখানকার আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যগুলির মধ্যে একটি ছিল এটিই। রাজতন্ত্রের অবসানের পর প্রাসাদটি জনসাধারণের জন্য জাদুঘর হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছিল। যার অন্দরে লুকিয়ে রয়েছে রাজতন্ত্রের মর্মান্তিক ইতিহাস। তা বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন অন্ধকার নেমে এসেছিল এই রাজপ্রাসাদে। তার পর আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল সেই রাজপ্রাসাদ। সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে নেপাল আর তার জেরেই পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে সব, ছাড় পায়নি রাজপ্রাসাদও।
এই প্রাসাদের জায়গায় ১৯ শতকের রাণা-যুগের ভবন ছিল যা ১৯৬০-এর দশকে, রাজা মহেন্দ্র একটি নতুন রাজকীয় বাসভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন যা দেখতে নেপালি ঐতিহ্যের হলেও আধুনিকতায় মোরা। তিনি এটির নকশা করার জন্য আমেরিকান স্থপতি বেঞ্জামিন পোলককে নিয়োগ করেছিলেন। বেঞ্জামিন ঐতিহ্যবাহী নেপালি মন্দিরের রূপগুলিকে আধুনিক, জৈব ধারণার সঙ্গে মিশিয়ে এই রূপ দিয়েছিলেন। যার মধ্যে যেমন প্রাসাদের লুক থাকছে, তেমনই রয়েছে আধুনিক শিল্পের ছোঁয়া। বিশাল এই রাজপ্রাসাদে প্রশস্ত উঠোন, একটি ছোট মন্দিরের উপরে একটি উঁচু কেন্দ্রীয় টাওয়ার, আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা হল এবং ব্যক্তিগত স্থান রয়েছে।
নির্মাণ কাজ ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে শেষ হয় এবং ১৯৭০-এর দশকে সম্পূর্ণ প্রাসাদটি ব্যবহার শুরু হয়। এর পূর্ণ ব্যবহারের আনুষ্ঠানিকতা ১৯৭০ সালের দিকে শুরু হয়। সুতরাং এই প্রাসাদ বহন করে চলেছে নেপালের ইতিহাস, এখন ট্যুরিস্টরা যে ভবনটি পরিদর্শন করেন তা মূলত বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সংস্কারের সময়ের।
এক দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রাজতন্ত্রের অবসানের ফলে একটি জনপ্রিয় আন্দোলনের পর, নারায়ণহিটি একটি ব্যক্তিগত রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
সরকার ২০০৮ সালে এই প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় এবং কমপ্লেক্সটিকে নারায়ণহিটি প্রাসাদ জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। প্রাসাদের রাষ্ট্রীয় কক্ষ, মুকুট রত্ন এবং আনুষ্ঠানিক জিনিসপত্র, আসবাবপত্র জনসাধারণের জন্য প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল। একসময় বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের আতিথেয়তাকারী কক্ষগুলিকে এখন প্রদর্শনী হিসেবে রাখা হয়েছে। সিংহাসন কক্ষ এবং রাজার ডাইনিং হল, রাজকীয় গ্যারেজে রাখা হেলিকপ্টার এবং গাড়ি দেখা যেত। যে রাজপ্রাসাদের অন্দরেই রয়েছে নারকীয় হত্যাকান্ডের কাহিনিও।
২০০১ সালের ১ জুনের সন্ধ্যাটা ছিল নেপালের জন্য মর্মান্তিক একটা সময়। ত্রিভুবন সদন নামে পরিচিত প্রাসাদের অংশে নারায়ণহিটির অভ্যন্তরে একটি পারিবারিক নৈশভোজের সময় হঠাৎই গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে এলাকা। পর পর গুলির শব্দে থমকে যায় সব, রাজা বীরেন্দ্র, রানী ঐশ্বর্য এবং আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর সামনে আসতে শুরু করে।
সরকারি তদন্তে উঠে আসে বীরেন্দ্রের বড় ছেলে যুবরাজ দীপেন্দ্রই এই হত্যালীলা চালান নিজের পরিবারের উপর। এবং সবাইকে খুন করার পর নিজেও আত্মহত্যা করেন। বলা হয় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন এবং পরে মারা যান। এই হত্যাকাণ্ড নেপালকে হতবাক করে দিয়েছিল, যা বদলে দিয়েছিল নেপালের রাজনৈতিক ভাগ্য। শোনা গিয়েছিল দীপেন্দ্র বিয়ে করতে চেয়েছিলেন দেবযানী রানাকে, কিন্তু তাঁর বাবা বীরেন্দ্র ও মা ঐশ্বর্য এর বিরোধিতা করেন, বিশেষ করে মায়ের বিপুল বিরোধিতা মানতে পারেননি ছেলে, তা নিয়েই অশান্তি শুরু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলেই মনে করা হয়, কারণ কী ঘটেছিল, সেই কথা জানানোর মতো কেউ বেঁচে ছিল না।
নারায়ণহিটি নেপালের বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস বহন করে চলেছে। রাজবংশীয় শাসন, জাতীয় গর্বের মুহূর্ত, আকস্মিক জাতীয় আঘাত এবং তারপরে রাজনৈতিক পরিবর্তন। স্থানীয় এবং দর্শনার্থী উভয়ের জন্যই, প্রাসাদটি পুরো নেপালের ইতিহাসকেই প্রতিধ্বনিত করে।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবর
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google
 

