দার্জিলিং মেল ঠিক সাড়ে আটটা নাগাদ যখন নামিয়ে দেয় New Jalpaiguri বা এনজেপি স্টেশনে, তখনও চোখে ঘুম লেগে থাকে। সেই ঘুম ঘুম চোখেই স্টেশনের ওভার ব্রিজ থেকে ধরা দেয় দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা, মুহূর্তে উধাও হয়ে যায় সারা রাত ট্রেন জার্নির সব ক্লান্তি। তবে হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে যা পলিউশন তাতে এ দৃশ্য ভাগ্যবাণেরই ভাগ্যে জোটে। কিন্তু ছোটবেলার দিকে যদি পিছন ফিরে তাকাই তাহলে সত্যি বলছি, এটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল না। এনজেপি স্টেশন থেকে যে বরফঢাকা পাহাড় দেখা যাবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। শুধু কী তাই? বিকেলে শিলিগুড়িতে জেঠুর বাড়ির ছাদ থেকে পাহাড় দেখতে উঠতাম। এখনও বোনের বাড়ির বারান্দা থেকে আকাশ পরিষ্কার থাকলে কার্শিয়ংয়ের পাহাড়ের গায়ে রাতের জ্বলে ওঠা আলো দেখি। এই সব কিছুর সঙ্গেই জুড়ে আছে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। আর জুড়ে আমার বাবা। ঠিক যেভাবে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রেলের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে সেন চৌধুরী পরিবার। আর আমার বাবা। কখনও দোমোহনি, কখনও নিউ দোমোহনি, নিউ ময়নাগুড়ি, গুয়াহাটি আর নিউ জলপাইগুড়ি। স্মৃতির ভাড়ে ভারাক্রান্ত না হলেও প্রতিবার যখন এই স্টেশনগুলোকে ছুঁয়ে যাই তখন অনেক কিছু উঁকি দিয়ে যায় মনের আনাচ-কানাচ।
উত্তরবঙ্গে থাকার সুবাদে সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন তো সব সময়ই ব্যবহার করতে হতো কিন্তু নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন ব্যবহার শুরু হয় উত্তরবঙ্গ ছেড়ে কলকাতা চলে আসার পর থেকে। তার আগে পর্যন্ত অনেক বেশি আমরা নিউ ময়নাগুড়ি বা জলপাইগুড়ি স্টেশন দিয়েই যাতায়াত করতাম। আমাদের গ্রাম দোমোহনি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন অনেকটাই দূর। প্রথমে এই নামটা নিয়েও আমার বেশ সংশয় ছিল। যে স্টেশন শিলিগুড়ি শহরে নিয়ে যাচ্ছে বা সেখান থেকে দার্জিলিং, সিকিম, সেই স্টেশনের নাম কী করে নিউ জলপাইগুড়ি হতে পারে। কারণ জলপাইগুড়ি তো সেখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, তাহলে এই স্টেশনের নাম কেন নিউ জলপাইগুড়ি? এই প্রশ্নের উত্তর পড়ে পেয়েছি, সেটা পরে বলছি। এখন প্রায় প্রতি বছর বার কয়েক এই স্টেশনে নামি আবার সেখান থেকে কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরি। কখনও পাহাড় তো কখনও কোনও আত্মীয়ের বাড়ি। নিউ জলপাইগুড়ি মানে আমার কাছে অনেক কিছু। কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যাওয়া সবার থেকে অনেকটাই আলাদা।
দার্জিলিং মেল যখন রাঙাপানি স্টেশনের গা ছুঁয়ে ছুটে যায় তখনই পাহাড়ি অনুভূতিটা হতে থাকে। লকডাউনের সময় এখান থেকেও দেখা দিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। অতীতে বহুবার চলন্ত ট্রেন থেকে ওই পাহাড়ের হাতছানি দেখেছি। তখন পাহাড়ের থেকে বেশি তাড়া থাকত পরিবারের লোকদের সঙ্গে দেখা করার। তার পর দল বেঁধে কার্শিয়ং। এখন অবশ্য আগে পাহাড়ে ছুটি। এনজেপিতে নেমে গাড়ি ধরে সোজা পাহাড়। এই স্টেশনটার একটা অদ্ভুত আবেদন আছে। কাতাড়ে কাতাড়ে মানুষ হয় পাহাড়ে ছুটছে অথবা পাহাড় থেকে ফিরছে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের ওয়েটিংরুম কখনও ফাঁকা থাকে না। সব সময় ঠাসাঠাসি ভিড়। সেই ভিড় ঠেলেই কখনও প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে পাহাড়মুখি গাড়ি ধরা অথবা পাহাড় থেকে নেমে ট্রেন ধরে শহরে ফেরা।
একবার মনে আছে, অনেকটা আগেই পাহাড় থেকে নেমে পড়েছিলাম। অতটা সময় ওই ভিড়ে ঠাসাঠাসি ওয়েটিংরুমে থাকব না বলে আগে থেকেই একটা রিটায়ারিং রুম বুক করে নিয়েছিলাম আইআরসিটিসি থেকে। বেশি দিন আগের কথা নয়। এই প্রথম এনজেপি স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে থাকা। অতীতে যাতায়াতের পথে দেখতাম। বাবার কাছে রিটায়ারিং রুমের গল্প শুনতাম। বাবা যাতায়াতের পথে এখানে থাকতেন। হয়তো বেশি রাতে ট্রেন ধরতে হতো বা অনেক সকালে। সেই সময় কলকাতা থেকে সরাসরি গুয়াহাটি যাওয়ার বেশ কয়েকটি ট্রেন ছিল, যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা, কামরূপ, সরাইঘাট। বাবার অফিস দোমোহনি থেকে চলে গিয়েছিল গুয়াহাটিতে। কলকাতা থেকে গুয়াহাটি যেতে হতো মাঝে মাঝেই। আমরাও তখন চলে যেতাম শিলিগুড়ি, অবশ্যই স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকলে। হ্যাঁ, শিলিগুড়ি স্টেশনও আছে। তবে সেখানে খুব বেশি ট্রেন দাঁড়ায় না। তাই কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গগামী মানুষের সবেধন নীলমণি এই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। ক্রমশ বাড়তে থাকা ট্যুরিজম, ট্রেন, মানুষের চাহিদাকে সামনে রেখে আজকের মতো করে সেজে উঠেছে এই স্টেশন। প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস সংযুক্ত হচ্ছে। এক্কেবারে জমজমাট। সে আপনি ভোরবেলায় পৌঁছন বা মধ্যরাতে, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন আপনাকে দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাবে।
সম্প্রতি যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামলাম, রাস্তাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথা দিয়ে বাইরে যেতে হবে। অ্যারো দিয়ে দিক নির্দেশ দেখে দেখে গাড়ির স্ট্যান্ডে যেতে হল। দেখলাম ঢেলে সাজছে আমাদের ছোটবেলার কত স্মৃতির এই স্টেশন। তৈরি হচ্ছে আলাদা পার্কিং। স্টেশন থেকে বেরিয়েই আগে ছিল গাড়ির স্ট্যান্ড। এখন তা অনেক দূরে। যেভাবে বিশালাকার স্টেশন চত্তর তৈরি হচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট ভারতীয় পর্যটনে উত্তরবঙ্গের বিপুল উত্থানই এর ফল। একটা সময় এই উত্তরবঙ্গ বেশ কিছুটা অবহেলিতই ছিল। জন্ম থেকে একটা দীর্ঘ সময় এখানেই কেটেছে আমার। তাই পার্থক্যটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, বদলটাও। একটা সময় ছিল মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যেত পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া। দার্জিলিং জুড়ে অশান্তি তখন কাশ্মীরকেও ছাঁপিয়ে গিয়েছিল। সেটা একটা কঠিন সময় কেটেছে ওই অঞ্চলে ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের। সে সব অতীত হয়েছে অনেক বছরই। এখন প্রতিবছর কাতাড়ে কাতাড়ে মানুষ দার্জিলিং যায়। একটা সময় ছিল বর্ষায় কেউ পাহাড়ে যেত না, এখন সে সবেরও বালাই নেই। তাই দার্জিলিং সব সময়ই জমজমাট। আর দার্জিলিং যখন জমজমাট তখন আরও বেশি জমজমাট নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন।
এবার একটু ফিরে দেখা যাক, তবে বেশি ইতিহাসের কচকচানি করব না। শুরুতেই বলেছিলাম, শিলিগুড়িতে কেন স্টেশনের নাম নিউ জলপাইগুড়ি? ভূগোল বলছে, এই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন যেখানে অবস্থিত সেটা জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে পড়ে। আর এই স্টেশন চত্তর থেকে বেরলেই শুরু হয়ে যায় দার্জিলিং জেলা। ভূগোলটা যে সত্যি গোল এটাও তার প্রমান। এই স্টেশনের নাম নিউ জলপাইগুড়ি হওয়ার পিছনে এটাই একমাত্র কারণ। যে স্টেশন উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার নামেও খ্যাত। যা উত্তরবঙ্গ, সিকিম এবং ভুটানের প্রবেশদ্বার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে উত্তরবঙ্গ এবং অসমের সাথে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশের রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আগে এই রেল যোগাযোগ বাংলার পূর্ব অংশের মধ্যে দিয়ে ছিল, যা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালের দিকে, পুরনো শিলিগুড়ি টাউন রেলওয়ে স্টেশনের উত্তরে একটি নতুন স্টেশন, শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন, বেশ কয়েকটি মিটার-গেজ লাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়াও, শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে শিলিগুড়ি জংশন হয়ে দার্জিলিং পর্যন্ত ন্যারো-গেজ দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ছিল। ১৯৫০ সালে সম্পন্ন অসম রেল সংযোগ প্রকল্পটি অসমের রেলপথকে কিষাণগঞ্জের সাথে একটি মিটার-গেজ লাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত করে। উত্তরবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত এই ট্রেন লাইনটি তিস্তা, তোর্ষা এবং সংকোশ নদীকে জুড়ে রেখেছে।
১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে, ভারতীয় রেলপথ মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত হতে শুরু করে এবং শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের দক্ষিণে একটি নতুন ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির (১,৬৭৬ মিমি) ব্রড-গেজ স্টেশন তৈরি করা হয়। যেহেতু নতুন স্টেশনটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত ছিল, তাই এর নামকরণ করা হয় নিউ জলপাইগুড়ি। ১৯৬৪ সালের মধ্যে, নিউ জলপাইগুড়ি এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশন হয়ে ওঠে। এতে ব্রডগেজ (কিষাণগঞ্জ, বারসোই, শিলিগুড়ি শহর এবং শিলিগুড়ি জংশন পর্যন্ত) এবং মিটারগেজ (শিলিগুড়ি শহর এবং শিলিগুড়ি জংশন পর্যন্ত) উভয় ট্র্যাকই ছিল। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ন্যারো-গেজ ট্র্যাকটি শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে নিউ জয়পাইগুড়ি স্টেশন পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছিল। যা এখনও আছে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি শহর এবং শিলিগুড়ি জংশন পর্যন্ত মিটার-গেজ ট্র্যাকটি পরে ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়।
ভারতীয় রেল যেমন ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত, তেমনই দেশের বিভিন্ন স্টেশনের গায়েও লেখা রয়েছে একাধিক ইতিহাস, যার উপর দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত চলে যাই আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে। সব স্মৃতি নিয়ে একলা দাঁড়িয়ে থাকে স্টেশন।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google