শরীর নিয়ে তো আমরা অনেক কিছু ভাবি, কিন্তু মন নিয়ে ক’জন ভাবি? Mental Health-এর সমস্যা সব সময়ই আমাদের সমাজে অগ্রাহ্য হয়ে এসেছে। এমন কিছু সমস্যা আছে যা পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি বা তীব্রভাবে প্রভাবিত করে, কারণ এর পেছনে জৈবিক, হরমোনাল, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। ঋতুস্রাব, গর্ভাবস্থা, প্রসবোত্তর এবং মেনোপজের সময় হরমোনের মাত্রার ওঠানামা নারীদের মানসিক অবস্থানের উপর আলাদা প্রভাব ফেলতে পারে। উপরন্তু, সামাজিক চাপ, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা এবং যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব প্রায়শই মহিলাদের উপর ভারী মানসিক বোঝা চাপিয়ে দেয়। এই কারণগুলিই বেশ কিছু মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং কীভাবে তাদের মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করার সময় এসেছে।
প্রতিমাসেই গুরে ফিরে যে সমস্যাটা মেয়েদের মধ্যে দেখা দেয় সেটা হল পিরিয়ড ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (PMDD), যা PMS এর চেয়েও গুরুতর, PMDD মাসিকের আগে তীব্র মেজাজের পরিবর্তন, বিরক্তি এবং বিষণ্ণতার কারণ তৈরি করে। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগব্যায়াম বা ধ্যানের মাধ্যমে চাপ কমানো, সুষম খাদ্য এবং SSRI বা হরমোন থেরাপির মতো চিকিৎসা লক্ষণগুলিকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করতে পারে।
এর পর যেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হল প্রসবপূর্ব উদ্বেগ ও প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা। মাতৃত্বকালীন আনন্দের মধ্যেই এই দু’টি মানসিক পরিস্থিতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গর্ভাবস্থায় মহিলাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ বাড়ে, বিশেষ করে যাঁরা প্রথমবার গর্ভবতী হয়েছেন। তাঁদের জন্য একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। যা প্রায়শই শিশুর স্বাস্থ্য বা প্রসবের ভয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রসবপূর্ব যোগব্যায়াম, মননশীলতা অনুশীলন, একজন থেরাপিস্টের সাহায্যে মানসিক অবস্থান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে এবং একজন বিশ্বস্ত কারও সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে, সে কেউ কাছের মানুষ হতে পারে বা কোনও বিশেষজ্ঞ। এর পরের অবস্থাটি প্রসবের পরে দেখা দেয়, যা দুঃখ, ক্লান্তি এবং শিশুর সঙ্গে জুড়ে থাকে। নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন একটি প্রাণকে বুকে আঁকড়ে বড় করার যে লড়াই, সেটা তখন থকেই শুরু হয়ে যায়। পরিবারের কাছ থেকে মানসিক সহায়তা, বিশ্রাম, খোলামেলা যোগাযোগ, পেশাদার পরামর্শ এবং কখনও কখনও ওষুধ এই চাপ কমাতে পারে। প্রসবোত্তর গ্রুপ এবং থেরাপি প্রায়শই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর পর একটা সময় আসে যখন মেনোপজের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যা শরীরে এক বিপুল পরিবর্তন ঘটায়। মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তনগুলি হতাশা, উদ্বেগ বা বিরক্তির কারণ তৈরি করতে পারে। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ, আচরণগত থেরাপি (CBT), হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি যদি প্রয়োজন হয় তা অনেকটাই কাজে আসতে পারে। এছাড়া কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন ফ্লেক্স সিড ব্যবহার শরীরকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি মানসিক স্থিতিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষণ হয়।
লিঙ্গ-ভিত্তিক ট্রমা এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) অনেকের জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। অনেক মহিলাই পারিবারিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি, বা মানসিক আক্রমণের কারণে মানসিক আঘাতের সম্মুখীন হন, যার ফলে PTSD হয়। ট্রমা-ইনফর্মড থেরাপি, নিরাপদ সহায়তা নেটওয়ার্ক, গ্রাউন্ডিং কৌশল এবং কখনও কখনও EMDR (চোখের নড়াচড়ার সংবেদনশীলতা হ্রাস এবং পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ) কার্যকর হয় এই সমস্যার ক্ষেত্রে।
এর সঙ্গে ভীষনভাবে জড়িত থাকে যাঁরা অত্যধিক যত্নশীল মহিলা। স্বাভাবিক চরিত্র অনুযায়ীই মহিলারা পুরুষদের থেকে অনেকবেশি যত্নশীল হয়। যার ফলে একটা সময়ের পর মানসিক ক্লান্তি চেপে বসে, বিশেষ করে যখন সেই যত্নশীলতা তাঁর আশপাশের মানুষদের কাছে আলাদা করে গুরুত্ব পায় না বরং যাঁরা ধরেই নেয় এটাই তাঁর দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে নিজের দায়িত্বের সীমানা নির্ধারণ, নিজের যত্নের রুটিন, বিশ্রাম নেওয়া এবং সেরকম মানুষকে জীবনে মূল্য দেওয়া যে পাল্টা যত্ন দিতে পারেন। এর সঙ্গে দরকার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা যা ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করতে পারে, নিজেকে ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারে। আস এই সবের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে সামাজিক প্রত্যাশা, যা ধিরে ধিরে কেড়ে নেয় মানসিক শান্তি। হারিয়ে যায় নিজের সময়। এই সব নিজের ইচ্ছেতেই ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করাটা জরুরী।
বিশেষ করে যে সব মহিলারা চাকরি করেন তাদের ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
পেশাদার পরিবেশে মহিলারা প্রায়শই পক্ষপাত, হয়রানি বা কম স্বীকৃতির সম্মুখীন হন, যার ফলে চাপ এবং উদ্বেগ তৈরি হয়। দৃঢ়তা প্রশিক্ষণ, পরামর্শদান, থেরাপি, কর্মক্ষেত্রে মিত্রতা গড়ে তোলা এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান নারীদের এই ধরনের চাপ মোকাবেলা করার ক্ষমতা দিতে পারে। আর এটাই সব থেকে বড় বিষয় যা একজনকে বাকিদের থেকে আলাদা করে। নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারা এবং অন্যকে বোঝানো।
এর পাশাপাশি বর্তমান সমাজে একাকিত্ব সব থেকে বড় একটা মানসিক রোগ। একা বা সন্তানহীন মহিলাদের মধ্যে একাকীত্ব স্বাভাবিক কিন্তু যখন অনেকের মধ্যে থেকেও একাকিত্ব আসে তখন বড় কঠিন জায়গায় পৌছে যায়। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, বন্ধু খুঁজে নিতে হয়। এর পাশাপাশি আরও একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আপনি নিজেই নিজের সব থেকে বড় বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। একা একা সব করা যায়, সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, শপিং করা সব সম্ভব। তাই নিজেকে সেই দিকে চালিত করতে পারলে জীবনটা একাই উপভোগ্য হয়ে উঠবে। এবং নিজেকে এমন কাজে ব্যস্ত রাখা যার একটা ভালো ফল আসতে পারে। তবেই দিনের শেষে মন ভালো থাকবে।
সৌভাগ্যক্রমে, সচেতনতা, সহায়ক সম্প্রদায়, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং পেশাদার সহায়তার মাধ্যমে, এই চ্যালেঞ্জগুলির অনেকগুলি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে। সঙ্গে পরিবারের মানুষদেরও সচেতন হতে হবে, বিশেষ করে জীবনসঙ্গীকে, সন্তানদের বুঝতে হবে বাড়ি যে মহিলাটি সারাক্ষণ সবার খেয়াল রাখছে তাঁরও দিনের শেষে এই কেয়ারটা দরকার।
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google