এটা ভালোবাসা নয়, এটা আত্মহত্যা, দোষী আপনিই

মেঘ চক্রবর্তী: কীসের এত আবেগ? কিসের এত উৎসব? কিসের জন্য সব কিছু ফেলে পাগলের মতো ছুটে যাওয়া আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়া একটা দলের সাফল্য উদযাপন দেখতে? পুলিশ, প্রশাসন, আয়োজক, দল, প্লেয়ারদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার আগে নিজেদেরকে এই প্রশ্নটা করুন দয়া করে? যদি সঠিক উত্তর পান তাহলে দেখবেন, আনন্দ, আবেগ সব নিজের জায়গায়, নিজের নিরাপত্তা সবার আগে। আবেগে ভেসে নিজের নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নষ্ট করার কোনও অধিকার আপনার নেই। আপনার অধিকার নেই একটা পরিবারকে সারাজীবনের জন্য হাহাকারের মধ্যে ছেড়ে যাওয়ার। বিশ্বাস করুন মানতে পারছি না। একদম মানতে পারছি না, এইভাবে বোধ, বুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে একটা দলের সাফল্যের জন্য আত্মহত্যা করাকে।

হ্যাঁ, জানি এই শব্দটায় অনেকেরই রাগ হবে। কিন্তু এটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই না। এখন পুলিশ কর্তার ট্রান্সফার হচ্ছে, ক্লাব কর্তা, আয়োজকরা গ্রেফতার হচ্ছে, এমন কী বিরাট কোহলির বিরুদ্ধেও এফআইআর হচ্ছে। কেন? কেন বিরাট কোহলির বিরুদ্ধে এফআইআর হবে বলুন তো? কেন পুলিশের কথা শুনে সেদিন রাজ্য সরকার অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেয়নি? তারাও তো এই অনুষ্ঠানে দারুণভাবে যুক্ত ছিলেন। তাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার সময় যেভাবে বিরাট কোহলি ভিড়ের ঠেলা খেতে খেতে এগোচ্ছিলেন তাতে যে কোনও সময় তিনিই পদপিষ্ট হয়ে যেতে পারতেন। কিসের এই আবেগ? যে মানুষটার নামে জয়ধ্বনী দিচ্ছেন, ভগবানের মতো পুজো করছেন, আনন্দে উত্তাল হচ্ছেন, তাঁর নিরাপত্তার কথাটাও তো ভাবলেন না আপনারা?


ভাববেনই বা কী করে, যাঁরা নিজেদের নিরাপত্তার কথাই ভাবতে পারেন না তাঁরা কী করে অন্য কারও নিরাপত্তার কথা ভাববেন। কেউ অফিসের কাজ মাঝ পথে ফেলে চলে গিয়েছেন, কেউ বাড়িতে মিথ্য কথা বলে, কেউ জেদ করে কিছু না জানিয়েই পৌঁছে গিয়েছিলেন। ভুল অবশ্যই পুলিশ, প্রশাসন, ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের ছিল কিন্তু সব থেকে বড় ভুল ছিল আপনাদের। যাঁরা কিছু না ভেবেই আবেগে গা ভাসিয়েছিলেন। যদি ৩০ হাজারের স্টেডিয়ামের জন্য ফ্রি পাসের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে তাহলে লাখ লাখ মানুষ কেন ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেন? কারণ তাঁরা নিয়ম ভেঙেই স্টেডিয়ামের ভিতর পৌঁছতে চেয়েছিলেন। এই টুকু বোধ কারও কাজ করল না, ৩০ হাজারের গ্যালারিতে ৫০ হাজার লোক ঢুকলেও সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, সেখানে তো দু’লাখের উপর ফ্যান হাজির হয়েছিলেন। আর গেট খুলতেই হুড়মুড়িয়ে দৌঁড়, যা হওয়ার তাই হল।

অনেকে এমনটাও জানাচ্ছেন, ভিড়ের জন্য বৈধ পাস থাকা স্বত্ত্বেও তাঁরা ঢুকতে পারেননি। ১১টি প্রাণ চলে যাওয়ার পিছনে দায়ী কে? সব থেকে বেশি দায়ী এই ১১টি মানুষই। দেখলাম একজন নাকি অফিসের ল্যাপটপ খুলে রেখেই চলে গিয়েছিলেন, একজন মায়ের কাছে বায়না করেছিলেন স্কুলে না গিয়ে স্টেডিয়ামে যাবে, এঁরা কেউ ফেরেনি। শুনছিলাম, সেদিন স্টেডিয়াম লাগোয়া মেট্রো স্টেশনের ভিতরেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানেও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়ায় বড় কোনও ঘটনার সম্মুখিন হতে হয়নি। তবে বাইরে আর সেটা সম্ভব হয়নি। এত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না আর সে কারণেই পুলিশ এই অনুষ্ঠান বুধবারের বদলে রবিবার করার অনুরোধ জানিয়েছিল। প্রশ্নটা করুন রাজ্য সরকারকে, তার পরও কেন রাজ্য সরকার এই অনুমতি দিল?

যারা আবেগে ভেসে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, যাঁরা আহত হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন বা যাঁরা হালকা চোট নিয়ে বাড়িতে রয়েছেন বা যাঁরা অল্পের জন্য প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছেন তাঁরা ছাড়া আর যদি কেউ দোষী হয় সেটা রাজ্য সরকার। পুলিশ না করা স্বত্ত্বেও রাজ্য সরকারের অনুমতি দেওয়ার ফল এই ভয়ঙ্কর ঘটনা। রাজ্য পুলিশকে পরিকল্পনা করার সময় না দিয়েই উৎসবে মেতে উঠলাম, এটা কি প্রশাসনের কাজ? উৎসবে গা ভাসানো কি প্রশাসনের কাজ? নাকি রাজ্যের মানুষের ভালো-মন্দ দেখাটা। সুযোগ বুঝে নেমে পড়লাম ফুটেজ খেতে। ১১টা প্রাণ চলে গেল, তাঁর পর তিনি পুলিশ কর্তাকে বদলি করছেন। পুলিশ তো চায়নি এটা হোক। হাই কোর্ট স্বতপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছে। সেখানে কারা গ্রেফতার হচ্ছেন? যাঁদের অধিকারই নেই পুলিশের বাধা স্বত্ত্বেও অনুষ্ঠান করার।

তাহলে কীভাবে তারা সেটা করলেন?

কারণ রাজ্য সরকার নিজেও অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। কেন তড়িঘড়ি এই অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্তৃপক্ষ? কারণ বিদেশি প্লেয়াররা দেশে ফিরে যাবেন, ভারতীয় দলের প্লেয়াররা ইংল্যান্ড উড়ে যাবে, তাই দ্রুত করে ফেলতে হবে উৎসব। কী হল? ১১টি তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে লেখা হল বেঙ্গালুরুর প্রথম আইপিএল জয়ের কাহিনি। যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এই দলটিকে। আর সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে সেই মানুষগুলোকে যাঁদের বাড়ির সন্তান হারিয়ে গেল ঠুনকো আবেগের স্রোতে ভেসে।

শেষে আরও একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, বেঙ্গালুরু তো দেশের আইটি হাব। পুরো দেশ থেকে মানুষ এখানে যায় চাকরি করতে। পেশার শহর। এই শহরে মানুষ নিজের পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পায়। সেই শহরে একটা পুরোদস্তুর কাজের দিনে মধ্য দুপুরে এত বেকার মানুষ কোথা থেকে এল? স্কুল, কলেজ, অফিস ছুটি ঘোষণা করেছিল বলেও তো শুনিনি।

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle