জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: হিরো আইএসএল মানেই এক ঝাঁক বিদেশি ফুটবলারের (Foreigners Of ISL 2022-23) মেলা, যাঁদের অনেকেই বিশ্বের সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবলের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লিগে খেলতে আসে। অনেকে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছতে না পারলেও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের দিক থেকে এগিয়ে থাকেন। এমন অনেক নামী বিদেশি তারকা হিরো আইএসএলে এসেও সুনাম বজায় রাখতে যেমন পারেননি, তেমনই অনেক অনামী খেলোয়াড়ও এই লিগে এসে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন, হয়ে উঠেছেন সকলের নয়নের মণি। ভারতের এক নম্বর লিগের পাঁচজন বহুচর্চিত তারকা, যাদের ওপর নজর থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন।
গ্রেগ স্টুয়ার্ট (সেন্টার ফরোয়ার্ড, মুম্বই সিটি এফসি)
হিরো আইএসএলের অন্যতম সেরা অ্যাটাকারকে এ বার জামশেদপুর এফসি থেকে নিজেদের শিবিরে নিয়ে এসেছে মুম্বই সিটি এফসি। এবং আনার পরই তারা হাতেনাতে ফল পেয়ে গিয়েছে মরশুমের প্রথম টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপে। এই স্কটিশ তারকাই টুর্নামেন্টের সেরা নির্বাচিত হন। হাফ ডজন গোল করেন তিনি। শুধু গোল করা নয়, চারটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন তিনি। অর্থাৎ দলের সাতটি ম্যাচে দশটি গোলে তাঁর প্রত্যক্ষ অবদান ছিল। এমন একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড কোন দলই বা না চাইবে? মুম্বইয়ের দলে পেরেইরা দিয়াজ ও আলবার্তো নগুয়েরার সঙ্গে খেলে তিনি আরও ধারালো হয়ে উঠতে পারেন।
গত মরশুমে জামশেদপুর এফসি-র হয়ে ২১ম্যাচে ১০টি গোল করেন স্টুয়ার্ট। এ ছাড়াও দশটি গোল করতে প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করেন। জামশেদপুরের লিগ শিল্ড জয়ের অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন ৩২ বছর বয়সি এই বিদেশি তারকা। এ বার মুম্বই সিটি এফসি-কেও তিনি সে ভাবেই বা আরও ভাল ভাবে সাহায্য করবেন, এমনই আশা ক্লাব কর্তৃপক্ষের। স্কটল্যান্ডের ডান্ডি এফসি থেকে ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপ ক্লাব বার্মিংহ্যাম সিটি-তে সই করেন স্টুয়ার্ট। সেখান থেকে লোনে গিয়েছিলেন আবেরদিন- এ। তাদের সঙ্গে ২০১৭-১৮-য় প্রিমিয়ারশিপে রানার্স-আপও হন।
তিনবছর বার্মিংহ্যামে কাটিয়ে স্টুয়ার্ট পড়েন লিভারপুল কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ডের হাতে, রেঞ্জার্স-এ। ২০২০-২১-এ তাঁরা লিগ খেতাব অর্জন করেন। ২০২১-২২ হিরো আইএসএল মরশুমের আগে গ্রেগ চলে আসেন জামশেদপুরে। সব মিলিয়ে ক্লাব ফুটবল জীবনে ৩৭৯টি ম্যাচ খেলে ১০৫টি গোল করেছেন ও ৮১টি করিয়েছেন। অর্থাৎ শুধু গোল করা নয়, গোল তৈরি করাতেও তিনি ওস্তাদ। এরকম অভিজ্ঞ এক তারকা মাঠে নামলেই চোখ সে দিকেই চলে যায়।
বার্থোলোমিউ ওগবেচে (ফরোয়ার্ড, হায়দরাবাদ এফসি)
চারটি মরশুমে ৭৭ ম্যাচ খেলে তাঁর ৫৩টি গোল করা ও সাতটি অ্যাসিস্ট করা হয়েছে। ৩৭ বছর বয়সে এখন জীবনে পড়ন্ত বিকেল ঢলে পড়লেও বিন্দুমাত্র তা মনে করেন না ওগবেচে। স্টুয়ার্টের মতো এই নাইজেরীয়ও যথেষ্ট কার্যকরী খেলোয়াড়। গতবার হায়দরাবাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তাঁর অবদান ছিল যথেষ্ট। তাই এ বছরও নিজামের শহরে ক্লাবে থেকে যান তিনি। হিরো আইএসএলে পা দেওয়ার পরে এই প্রথম কোনও ক্লাবে এক মরশুমের বেশি থাকলেন তিনি। গতবার ২০ ম্যাচে ১৮ গোল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। তার পরে একাধিক ক্লাব থেকে তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের প্রস্তাব আসে। কিন্তু তিনি হায়দরাবাদকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন।
২০১৮-য় তিনি ভারতে আসেন নর্থইস্ট ইউনাইটেডের ডাকে। পরের মরশুমে কেরালা ব্লাস্টার্সে যোগ দেন। সেখানে ১৬ ম্যাচে ১৫ গোল করেন, যা সেই ক্লাবের ইতিহাসে এক মরশুমে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর। তবে ২০২০-তে মুম্বই সিটি এফসি-তে যোগ দিয়ে অত গোল করতে পারেননি। ২০ ম্যাচে সাত গোল করেন তিনি। কিন্তু হায়দরাবাদে যোগ দেওয়ার পরে তাঁর সোনার দিন ফিরে আসে। দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন এবং নিজেও গোল্ডেন বুট পান ১৮ গোল করে। এ বার হায়দরাবাদের জার্সি গায়ে কী চমক দেবেন, সেটাই দেখার।
জনি কাউকো (অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, এটিকে মোহনবাগান)
উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে খেলে সোজা ভারতে হিরো আইএসএল খেলতে আসা একমাত্র ফুটবলার এই জনি কাউকো, যিনি ফিনল্যান্ডের জার্সি গায়ে ২০২১-এর ইউরোর মাঠে নামার পরই এটিকে মোহনবাগানে সই করেন। চিরকাল ইউরোপের আবহাওয়ায় খেলে আসা কাউকো ভারতে এসে বেশ সময় নেন।
সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল একজন ইউরো খেলে আসা ফুটবলারের, তা অনভিপ্রেত। উজবেকিস্তানের কার্শি শহরের মার্কাজি স্টেডিয়ামে এএফসি কাপ ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে প্রথমার্ধেই পাঁচ গোল খেয়ে যায় এটিকে মোহনবাগান। দ্বিতীয়ার্ধে নিজেদের শুধরে নিয়ে কিছুটা ভাল খেললেও ম্যাচে ফেরার কোনও বাস্তব সম্ভাবনাই ছিল না তাদের। সেই হারের দুঃসহ স্মৃতি এখনও ভোলেননি কাউকো।
তবে নিজেকে ক্রমশ তুলে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়। এক বছর আগের জনি কাউকো আর এখনকার জনি কাউকোর মধ্যে যে কতটা তফাৎ, তা এখন সবারই জানা। এই এক বছরে ভারতের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিজেকে ক্রমশ নিজের সেরা জায়গায় নিয়ে এসেছেন তিনি। গত হিরো আইএসএলে দল যখন কোভিড, চোট-আঘাতে আক্রান্ত হয়ে কঠিন দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন এই ফিনল্যান্ডের তারকাই দলের হাল ধরেন। সেই মরশুমে নর্থইস্ট, ব্লাস্টার্স ও ওডিশার বিরুদ্ধে তাঁর তিনটি গোল যতটা না দামী ছিল, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ছ’টি অ্যাসিস্ট। সেই সময় কাউকো দলের হাল না ধরলে এটিকে মোহনবাগান হয়তো গতবার সেমিফাইনালে উঠতেই পারত না। তবে এই মরশুমের প্রথম টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপে তেমন ভাল শুরু হয়নি তাঁর। তিনটি ম্যাচে খেলার পরে চতুর্থ ম্যাচে তিনি দলেও ছিলেন না। কিন্তু হিরো আইএসএলে ফের নিজের সেরাটা মেলে ধরতে পারবেন, এই আশায় রয়েছেন সমর্থকেরা।
রয় কৃষ্ণা (ফরোয়ার্ড, বেঙ্গালুরু এফসি)
গত তিন মরশুম কলকাতা মাতিয়ে এ বার ফিজিয়ান স্ট্রাইকার রয় কৃষ্ণা সুনীল ছেত্রীর বেঙ্গালুরু এফসি-তে। এ বছর জুনে ফিজির এই তারকাকে বিদায় জানায় এটিকে মোহনবাগান। সম্ভবত কোচ হুয়ান ফেরান্দোর খেলার স্টাইলের সঙ্গে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারছিলেন না রয়। সেই জন্যই অব্যহতি চান তিনি। বেঙ্গালুরু এফসি-তে গিয়ে নিজেকে আগের মতো মেলে ধরতে শুরু করেছেন।
নতুন দলে গিয়ে মানিয়ে নিয়েছেন বেশ। ডুরান্ড কাপেই তার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। তিনটি গোল করেন মরশুমের প্রথম টুর্নামেন্টে। জামশেদপুর এফসি, ভারতীয় বায়ূসেনা ও কোয়ার্টার ফাইনালে ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে। কোয়ার্টার ফাইনালে ওডিশার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সময়ের একেবারে শেষ মিনিটে তাঁর দুর্দান্ত গোলেই ম্যাচ জেতে বেঙ্গালুরু এফসি। মরশুমের প্রথম টুর্নামেন্টেই নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন ৩৫ বছর বয়সি এই সেন্টার ফরোয়ার্ড।
২০২০-২১ হিরো আইএসএলের গোল্ডেন বল জয়ী ফুটবলার রয় কৃষ্ণা ২০১৬ অলিম্পিক্সে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে তিনি গোল দেন। ওয়েলিংটন ফিনিক্সের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ২০১৯-এ ভারতে চলে আসেন রয়। ভারতে প্রথম মরশুমে ১৫টি ও দ্বিতীয় মরশুমে ১৪টি গোল করার পরে গত বারও তিনি প্রচুর গোল করবেন বলে আশা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু কোভিড ও চোট-আঘাতের কারণে গত হিরো আইএসএলে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি ফিজির তারকা ফরোয়ার্ড। ১৬ ম্যাচে সাতটি গোল করেন ও চারটি করান।
তবে এই মরশুমে নিজেকে তাঁর আসল জায়গায় ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ রয়ের সামনে। ডুরান্ড কাপে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু দীর্ঘ লিগে সত্যিই কতটা কী করতে পারবেন, সেটাই আকর্ষণের বিষয়।
ইভান গঞ্জালেজ (সেন্টার ব্যাক, ইস্টবেঙ্গল এফসি)
ইস্টবেঙ্গল এফসি এ বার নতুন দল গড়ে শুরুতেই ডিফেন্সের অন্যতম সেরা তারকা ইভান গঞ্জালেজকে সই করিয়ে নিয়েছে। গত বছর এফসি গোয়ার হয়ে খুব ভাল পারফরম্যান্স দেখান এই স্প্যানিশ ডিফেন্ডার। ১৭টি ম্যাচ খেলেন তিনি। পাসিং অ্যকিউরেসি ছিল ৮৩.২৪%। প্রায় ছ’ফুট লম্বা এই সেন্টার ব্যাক দলের রক্ষণের স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারেন, এ রকম আশা করছেন সমর্থকেরা। মরশুমের শুরুতে ডুরান্ড কাপে সে রকম ইঙ্গিত কিছুটা পাওয়াও গিয়েছে।
ডুরান্ড কাপে ইভানকে মাত্র দুটি ম্যাচে খেলান তাদের কোচ স্টিফেন কনস্টান্টাইন। রাজস্থান ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে যে ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করে ইস্টবেঙ্গল এফসি, সেই ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে নামেন তিনি। এই ম্যাচে লাল-হলুদ রক্ষণের দৃঢ়তার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। এটিকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধেও তিনি পুরো ৯০ মিনিট খেলেছিলেন। সেই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের আত্মঘাতী গোলে জেতে এটিকে মোহনবাগান। কিন্তু সমস্যা হল দুই ম্যাচেই হলুদ কার্ড দেখেন ইভান। এই ব্যাপারে তাঁকে আরও সংযত হতে হবে।
রিয়াল মাদ্রিদের যুব অ্যাকাডেমির ফসল ইভান গঞ্জালেজ সেই ক্লাবের সি দলের খেলেন। পরে সেখান থেকে দেপোর্তিভো বি-সহ আরও কয়েকটি স্প্যানিশ লোয়ার ডিভিশন ক্লাবে খেলেন। ২০২০-২১-এ এফসি গোয়ায় যোগদান করেন তিনি। সে বার তাদের সেমিফাইনালে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ইভান। তাদের হয়ে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও খেলেন। বর্তমান এটিকে মোহনবাগান কোচের প্রশিক্ষণে সেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে গ্রুপে তিন নম্বর জায়গাটা পায় তারা। এ বার লাল-হলুদ শিবিরের সাফল্যে সে রকমই অবদান রাখতে পারবেন কি না ইভান, সেটাই প্রশ্ন।
(লেখা আইএসএল ওয়েবসাইট থেকে)
প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে
জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: Facebook, Twitter, Google