Kolkata Derby-র ইতিহাসে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ কেমন ছিল

Kolkata Derby

জাস্ট দুনিয়া ডেস্ক: হাতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তার পরই ভারতীয় ফুটবলের সেই মহাদ্বৈরথ দেখতে পাবেন ফুটবলপ্রেমীরা। এটিকে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি। শতবর্ষ পেরনো ডার্বির (Kolkata Derby) লড়াই কেমন হবে, সে তো সময় জানে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে ফুটবল মহলে। কারা এগিয়ে, কারা পিছিয়ে। কার প্রস্তুতি কেমন। কে কোথায় দাঁড়িয়ে— এইসব প্রশ্নে এখন সরগরম বঙ্গের অলিগলি। রক মাতাচ্ছেন দুই দলের সমর্থকেরা। আড্ডাগুলো দু’ভাগে ভাগ হতে শুরু করে দিয়েছে অনেক আগে থেকেই। যেগুলো এখনও ভাগ হয়নি, সেগুলোতে রোজ উঠছে ঝড়। সোশ্যাল মিডিয়া তো সব সময়ই সরগরম। শনিবার রাতে কাদের মুখের হাসি বেঁচে থাকবে, তা এখনই আন্দাজ করা কঠিন। তবু বিতর্ক চলছেই।

স্বাভাবিক ভাবেই হিরো আইএসএলে কলকাতা ডার্বিই জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ২০২০-র নভেম্বরে দেশের এক নম্বর ফুটবল লিগে প্রথমবার মুখোমুখি হয় সবুজ-মেরুন ও লাল-হলুদ বাহিনী। রেকর্ডসংখ্যক দর্শক সেই ম্যাচ দেখেন টিভি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। এ বার সমর্থকেরা গ্যালারিতে বসে দেখবেন তাঁদের প্রিয় দলের খেলা। গলা ফাটাবেন প্রিয় তারকাদের জন্য। ডার্বির আবহ যখন তৈরি হয়েই গিয়েছে, তখন ফিরে যাওয়া যাক গত দুই মরশুমের ডার্বির দিনগুলোতে।

মরশুম ২০২০-২১, প্রথম লেগ

২৭ নভেম্বর, ২০২০, তিলক ময়দান স্টেডিয়াম, ভাস্কো

এটিই ছিল এসসি ইস্টবেঙ্গলের প্রথম হিরো আইএসএল ম্যাচ। অন্য দিকে এটিকে মোহনবাগানের কাছে সেটি ছিল লিগের দ্বিতীয় ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে কেরালা ব্লাস্টার্সকে এক গোলে হারানোর পরে স্বাভাবিক ভাবেই সবুজ-মেরুন শিবির ছিল আত্মবিশ্বাসী। আর প্রথম ম্যাচই চিরপ্রতিদ্বন্দী দলের বিরুদ্ধে হওয়ায় এসসি ইস্টবেঙ্গল ছিল একটু নার্ভাস। ৪৯ মিনিটে রয় কৃষ্ণা ও ৮৫ মিনিটে মনবীর সিংয়ের দুর্দান্ত দুই গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দীদের হারায় সবুজ-মেরুন শিবির। বিপক্ষের কড়া ডিফেন্সের দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেঙে গোল করার সে রকম সুযোগ তৈরি করতে পারেনি লাল-হলুদ বাহিনী। ৫৮ শতাংশ বল পজেশন থাকলেও ম্যাচের দখল নিতে পারেনি এসসি ইস্টবেঙ্গল।

কৌশলের আসল লড়াই দেখা যায় প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকেই। প্রথম ৪৫ মিনিটে এটিকে মোহনবাগানের তারকা স্ট্রাইকার জুটি রয় কৃষ্ণা ও ডেভিড উইলিয়ামসকে দেখে কিন্তু একবারও মনে হয়নি তাঁরা স্বচ্ছন্দে ছিলেন। তবে দ্বিতীযার্ধের শুরুতেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ফিজির তারকা এবং ৪৯ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করে এগিয়ে দেন দলকে। বাঁদিকের উইং দিয়ে জয়েশ রানে প্রথমে বল দেন ফাঁকায় থাকা হাভিয়ে হার্নান্ডেজকে। তিনি পাস দেন রয়কে এবং নিখুঁত ভাবে কাজটা শেষ করেন তিনি। ড্যানিয়েল ফক্স তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারেননি। তাঁর পায়ের তলা দিয়েই রয় দূরপাল্লার শটে ঝড়ের গতিতে বল পাঠান সোজা গোলে।

সে বার হিরো আইএসএলে অন্যতম সেরা রক্ষণ ছিল এটিকে মোহনবাগানের। তাঁদের তৎপরতায় গোলকিপার অরিন্দম ভট্টাচার্যকে ৭০ মিনিট পর্যন্ত মাত্র একটি বল সেভ করতে হয়। অন্য দিকে, দেবজিৎ মজুমদারকে সে দিন অনেক বেশি পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় এসসি ইস্টবেঙ্গলের হতাশা বাড়িয়ে তুলতে ৮৫ মিনিটে অসাধারণ একটি গোল করেন মনবীর সিং। ডান দিকের উইং দিয়ে উঠে নিজেই গোল তৈরি করে কোনাকুনি শটে দর্শনীয় গোলটি করেন মনবীর।

দ্বিতীয় লেগ, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম, ফতোরদা

নভেম্বরে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে হারানোর পরে এটিকে মোহনবাগান দ্বিতীয় ডার্বির আগে পর্যন্ত যে ১৫টি ম্যাচ খেলে, তার মধ্যে ন’টিতেই জেতে। ফিরতি লিগে যখন তারা চিরপ্রতিদ্বন্দীদের মুখোমুখি হয়, তখন লিগ টেবলের এক নম্বরে সবুজ-মেরুন শিবির। আগের চার ম্যাচে দশ গোল করে তারা। অন্য দিকে, প্রথম ও দ্বিতীয় ডার্বির মধ্যে ১৬টি ম্যাচ খেলে এসসি ইস্টবেঙ্গল। তার মধ্যে পাঁচটিতে ছিল হার। একটা সময়ে তারা টানা সাতটি ম্যাচে অপরাজিত ছিল। দ্বিতীয় ডার্বির আগের দুই ম্যাচেই জামশেদপুর এফসি-কে হারায় ও হায়দরাবাদ এফসি-র সঙ্গে ড্র করে রবি ফাউলারের দল। তাই ফিরতি ডার্বি নিয়ে আশায় ছিলেন লাল-হলুদ সমর্থকেরা।

ফিরতি লেগের ম্যাচ ৩-১ গোলে জিতে নেয় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। ম্যাচের শুরুতেই রয় কৃষ্ণা এবং দ্বিতীয়ার্ধে ডেভিড উইলিয়ামস ও হাভিয়ে হার্নান্ডেজের গোলে জয় ছিনিয়ে নেয় তারা। তাঁদের সতীর্থ ডিফেন্ডার তিরির আত্মঘাতী গোল এসসি ইস্টবেঙ্গলকে সমতা এনে দেওয়া সত্ত্বেও অবশ্য সেই স্কোর ধরে রাখতে পারেনি লাল-হলুদ শিবির।

এসসি ইস্টবেঙ্গল মাঝমাঠে লড়াই করলেও প্রতিপক্ষের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তাদের রক্ষণ ভেঙে পড়ে ও আক্রমণের ব্যর্থতাই তাদের হার মানতে বাধ্য করে। এটিকে মোহনবাগানের রক্ষণ যেমন বিপক্ষের সামনে দুর্ভেদ্য দেওয়াল হয়ে উঠেছিল, এসসি ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডাররা কিন্তু রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসদের ধরে রাখতে পারেননি।

সারা ম্যাচে যেখানে সবুজ-মেরুন ফরোয়ার্ডরা সাতবার গোলে শট নিয়েছেন, ব্রাইট ইনোবাখারে, অ্যান্থনি পিলকিংটনরা সেখানে সারা ম্যাচে একটির বেশি শট গোলে রাখতে পারেননি। তাদের সেরা স্ট্রাইকার ব্রাইটকে সে দিন কড়া পাহাড়ায় রেখে দিয়েছিলেন প্রীতম, সন্দেশ, তিরিরা। পিলকিংটন, মাঘোমারাও সুবিধা করতে পারেননি।

মরশুম ২০২১-২২, প্রথম লেগ

২৭ নভেম্বর, ২০২১, তিলক ময়দান স্টেডিয়াম, ভাস্কো

হিরো আইএসল ৮-এর শুরুটা যে ভাবে করতে চেয়েছিল লাল-হলুদ শিবির, সেভাবে করতে পারেনি। জামশেদপুর এফসি-র বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে তারা। শুরুতে গোল দিয়ে বিরতির ঠিক আগে গোল খেয়ে যাওয়ার পরে আর দ্বিতীয়ার্ধে গোলের মুখ খুলতে পারেননি তাদের ফরোয়ার্ডরা। পেরোসেভিচ বহু চেষ্টা করলেও চিমা ম্লান থাকায় কাজের কাজটি করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। তবে মর্চেলা ও পর্চের পারফরম্যান্স আশা জাগানোর মতোই ছিল। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে দাপুটে জয় দিয়ে সে বারের মরশুম শুরু করে এটিকে মোহনবাগান। কেরালার ব্লাস্টার্সকে ৪-২-এ হারায় তারা। আগের বারের চ্যাম্পিয়ন মুম্বই সিটি এফসি থেকে নিয়ে আসা ফরাসি মিডফিল্ডার হুগো বুমৌস সে দিন নিজে দুটি গোল করা ছাড়াও একটি গোলে অ্যাসিস্টও করেন।

সেই ডার্বিতেও এটিকে মোহনবাগানের আধিপত্য এতটুকু কমেনি। ২৩ মিনিটের মধ্যেই এগিয়ে যাওয়া এটিকে মোহনবাগানকে বাকি সময়টা কোনও রকমে ঠেকিয়ে রাখে তারা। শেষ পর্যন্ত ৩-০-য় জিতলেও নিজেদের ভুলে ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ নষ্ট করে তারা। এসসি ইস্টবেঙ্গল ম্যাচটা আক্রমণাত্মক মেজাজে শুরু করলেও দশ মিনট পর থেকে ম্যাচের রাশ নিয়ে নেয় এটিকে মোহনবাগান। ১৪ মিনিটের মধ্যে জোড়া গোলে এগিয়ে যায় তারা। রয় কৃষ্ণা ও মনবীর সিং দলকে এগিয়ে দেওয়ার পরে ২৩ মিনিটের মাথায় ফের চিরপ্রতিদ্বন্দীরা ধাক্কা খায় লিস্টন কোলাসোর সুযোগসন্ধানী গোলে। এই গোলের সময় অভাবনীয় ভুল করতে দেখা যায় এ বছরই সবুজ-মেরুন থেকে লাল-হলুদ শিবিরে আসা গোলকিপার ও অধিনায়ক অরিন্দম ভট্টাচার্যকে। শুধু ভুল নয়, চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলেও যেতে হয় তাঁকে। এই অবস্থায় বিপর্যস্ত এসসি ইস্টবেঙ্গল শিবির আর খেলায় ফিরতে পারেনি। সারা ম্যাচে একটি শটও গোলে রাখতে পারেনি তারা।

দ্বিতীয় লেগ, ২৯ জানুয়ারি, ২০২২, জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম, ফতোরদা

তখন হিরো আইএসএল টেবলে এসসি ইস্টবেঙ্গল ও এটিকে মোহনবাগানের মধ্যে দূরত্ব খুব একটা বেশি ছিল না। প্রথম দল এগারোয়, অপর পক্ষ আট নম্বরে। সবুজ মেরুনের এই জায়গায় থাকার কারণ অবশ্য কোভিডের তাণ্ডবে তাদের কম ম্যাচ খেলা। দুর্দান্ত খেলেও ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচের শেষে গোলশূন্য ড্র করে মাঠ ছাড়তে হয় সবুজ-মেরুন বাহিনীর সেনাদের। এসসি ইস্টবেঙ্গলের দশা ছিল আরও শোচনীয়। হায়দরাবাদ এফসি-র কাছে ০-৪-এ হার মানতে হয়! সেই ডার্বি না জিততে পারলে গতবারের রানার্স এটিকে মোহনবাগানের কপালে দুঃখ ছিল। সেরা চারে ওঠার সুযোগ থাকলেও শীর্ষে ওঠার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যেত।

২১ বছর বয়সি ফরোয়ার্ড কিয়ান নাসিরি জীবনের প্রথম ডার্বি খেলতে নেমে সে দিন যে ভাবে বিপক্ষের ডিফেন্সের বুক চিরে আধ ঘণ্টার মধ্যে পরপর তিনটি গোল করে এটিকে মোহনবাগানকে জেতান, তার জন্য বোধহয় কোনও বিশেষণই যথেষ্ট ছিল না। সারা ম্যাচে দুরন্ত লড়াই করে ড্যারেন সিডোলের গোলে এগিয়ে যাওয়া এসসি ইস্টবেঙ্গল ২১ বছরের সেই তরুণের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। ডেভিড উইলিয়ামস পেনাল্টি মিস করা সত্ত্বেও সাফল্যের ধারা অব্যহত রেখে ৩-১-এ ডার্বি জিতে নেয় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। এই জয়ের ফলে লিগ টেবলে আট থেকে চার নম্বরে উঠে আসে এটিকে মোহনবাগান। শীর্ষে থাকা হায়দরাবাদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান দাঁড়ায় পয়েন্টের।

৬১ মিনিটের মাথায় দীপক টাঙরির জায়গায় কিয়ানকে মাঠে নামিয়েছিলেন এটিকে মোহনবাগান কোচ হুয়ান ফেরান্দো। অচেনা শত্রু বরাবরই বিপজ্জনক। এবং সেই অচেনা শত্রুই শেষ পর্যন্ত এসসি ইস্টবেঙ্গল শিবিরের জন্য চরম দুঃসংবাদ বয়ে আনেন। মাঠে নেমে প্রথমেই যে টাচটি করেন তিনি, তাতেই আসে প্রথম গোল। ম্যাচের শেষ মিনিটে ও স্টপেজ টাইমের তৃতীয় মিনিটে আরও দু’টি গোলে নিজেকে চিনিয়ে দেন কিয়ান নাসিরি। ভারতীয় ফুটবলে জন্ম হয় এক নতুন তারকা স্ট্রাইকারের। আশির দশকের কিংবদন্তি ফুটবলার জামশেদ নাসিরির পুত্র কিয়ান বুঝিয়ে দেন, তাঁর রক্তেই ফুটবল।

(লেখা আইএসএল ওয়েবসাইট থেকে)

প্রতিদিন নজর রাখুন জাস্ট দুনিয়ার খবরে

জাস্ট দুনিয়ার সঙ্গে গোটা বিশ্বকে রাখুন নিজের পকেটে। Follow Us On: FacebookTwitterGoogle